যা ভেবেছিল তাই। পিসীও শুনে আকাশ থেকে পড়ল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে ঝুমরি আবার এদিকে ছুটে এলো। সেই সঙ্গে হাঁকডাক করে আমাদেরও ডাকল। কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যেই বাথরুম ছেড়ে মধু হাওয়া। সব শুনে আমরা স্তম্ভিত। বাড়িতে আর কাক-পক্ষী নেই। এক মিনিটের মধ্যে ফিরে গিয়ে ঝুমরি ওকেই দেখেছে বাথরুমে। হারের খোঁজ নেবার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা তাকের দিকে তাকিয়েছে বোকার মতো। অর্থাৎ যেখানে হার ছিল সেখানে আপনা থেকেই চোখ গেছে। আর ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বালতি ফেলে ও নিখোঁজ। ও যে হার নিয়েছে তাতে আর সন্দেহের কি থাকতে পারে? কিন্তু আমরা আরো হতবাক এই কারণে, মধু শেষ পর্যন্ত ঝুমরির জিনিস চুরি করতে পারে। এর থেকে অবিশ্বাস্য আর যেন কিছু নেই। আর ঝুমরিরও হয়তো এত রাগ সেই কারণেই। তলায় তলায় ওই লোকটাকে সে নিজের দাসানুদাস ভাবত। রাগে জ্বলে জ্বলে বার বার বলতে লাগল, এই চুরি একরকম স্বচক্ষেই দেখেছি আমি–যখন চাইলাম তখন হার ওর কাছেই ছিল–বোকার মতো মামীর কাছে ছুটে যেতেই হার সরানোর জন্য ও চোখে ধুলো দিয়ে গেল।
বেশ একটা উত্তেজনার হাওয়া থিতিয়ে উঠল বাড়িতে। কৃষ্ণকুমারের বাবাও সব শুনে স্তম্ভিত। কৃষ্ণকুমারও নির্বাক। মোট কথা, মধু এ-রকম কাজ করতে পারে কারো কল্পনার মধ্যেও ছিল না।
বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না। আধ ঘন্টার মধ্যে ও মূর্তি নিজেই এসে হাজির আবার। তেমনি ড্যাবডেবে চাউনি, ভাবলেশশূন্য মুখ। এ-রকম বিশ্বাসঘাতকতার ফলে বাড়ির কর্তা অর্থাৎ কৃষ্ণকুমারের বাবারও অগ্নিমূর্তি। সে আসার সঙ্গে সঙ্গে হুমকি দিয়ে উঠলো, হার বার কর।
মধু মাথা নাড়ল। নেয়নি বা জানে না।
কর্তা ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল গালে।–নিসনি তো হার গেল কোথায়? বার কর শিগগির।
কালো মুখে চড়ের লালচে দাগ পড়ে গেল। চুপচাপ কৰ্তার মুখের দিকেই চেয়ে। রইল সে।
কর্তা গর্জে উঠলো, এই আধঘণ্টা কোথায় ছিলি তুই? কোথায় গেছলি?
মধু জবাব দিল, দিদিমণি চোর বলাতে দুঃখ হল, তাই বাগানে বসেছিলুম।
এর মধ্যে আমরা ওর খোঁজে বাগানে ঘুরে এসেছি। এই মিথ্যেও হাতে-নাতে ধরা। পড়ল। অব্যক্ত রাগে হাত আমাদেরও নিশপিশ করছিল। কিন্তু আমাদের চেঁচামেচির জবাবে ও যে-ভাবে তাকাচ্ছিল এত বড় অপরাধের পরেও কি জানি কেন গায়ে হাত তোলার সাহস আমাদের হল না।
কর্তাই আরো কটা চড়চাপড় বসালো, অনেক ভয় দেখালো, ভাল কথায়। হার ফেরত দিতে বললো, কিন্তু মধুর কানে তুলো, পিঠে কুলো। শেষে পুলিসে খবর দেওয়া হল। তারা ওকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে তিন দিন আটকে রেখে অনেক জেরা করল, মারের চোটে হাড় গুঁড়িয়ে দেবার উপক্রম করল, কিন্তু কবুল। করাতে পারল না। ফলে ছেড়ে দিয়ে ওর ওপর চোখ রাখার মতলব ফাঁদল তারা। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। বাড়ির দাওয়ায় না এসে মধু সোজা বাগানে নিজের ঘরে। গিয়ে ঢুকল। রাতে খেতেও এলো না। কেউ ডাকেনি ওকে। পরদিন ভোরে ওর আর টিকি দেখল না কেউ। আবার পুলিসে খবর গেল। কিন্তু পুলিসও তার নাগাল পেল না।
মধু যাদবের অধ্যায় এখানেই শেষ। আর কখনো কেউ তাকে এলাহাবাদেই দেখেনি। মায়ের স্মৃতি ঝুমরির সেই হার খোয়া যেতে আমাদেরও একটু দুঃখ হয়েছিল। বটে, কিন্তু ওই মূর্তি বিদেয় হবার ফলে এক ধরনের স্বস্তি বোধ করেছিলাম। লোকটা যেন জানত, অসুখের দরুন কৃষ্ণকুমারকে সঙ্গ দিতে আসা, বা রাজনীতি আলোচনার লোভে এ-বাড়িতে ছুটে-ছুটে আসার লোভটাই সব নয়, এ ছাড়াও আরো কিছু বাড়তি আকর্ষণ আছে। ভাবলেশশূন্য মুখে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থেকে ও যেন এটুকুই ভাল করে বুঝিয়ে দিত আমাদের। এমনও মনে হয়েছে, কখন না জানি টুটি টিপে ধরে। সোজা যমের দোর দেখিয়ে দেয়।
এই লোক গেছে আপদ গেছে।
মধু যাদব বিদেয় হবার তিন সপ্তাহের মধ্যে সুলক্ষণা উধাও। আগের দিনও তাকে দেখেছি, কথা বলেছি। আমাদের মনে এতটুকু খটকা লাগার মতো কোনো কারণ ঘটেনি। ওর হাব-ভাব আচরণের কিছুমাত্র ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি আমাদের। কেবল শেষের দিন দশ-বারো কৃষ্ণকুমারের সেবাযত্ন বেশি করছিল। আর, একটা জলজ্যান্ত লোক বাপের চিকিৎসার দম্ভের চোটে কোন খেয়া পাড়ি দিতে চলেছে, অথচ আমরা চোখ কান বুজে বসে আছি–ইদানীং সেই ঝঝের কথাও একটু বেশি শোনা যাচ্ছিল। এর কোনোটাই ও-মেয়ের ভিতরের কোনো মতলবের নজির নয়। তাই খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হকচকিয়ে গেছি, দিশেহারা হয়েছি। কৃষ্ণকুমারেরও একই রকম অবস্থা প্রথম। তারপর হঠাৎ কি রকম যেন ঠাণ্ডা মেরে গেছে। বিবর্ণ পাংশু মুখ। তার পাশে বসেই তার বাবার তর্জন-গর্জন শুনেছি। স্ত্রীর মানসিক অবস্থা দেখে ভদ্রলোকের মেজাজ আরো বেশি তপ্ত। চিৎকার করে থেকে থেকে এক কথাই বলেছিলো।–কার জন্য এমন হা-হুঁতাশ করছ, কি জন্য খবর করতে বলছ? যে মেয়ে এ-ভাবে মুখে চুন-কালি দিয়ে চলে গেল, খুঁজে-পেতে তাকে ধরে এনে আবার ঘরে ঢোকাব? একেবারে মুখ বুজে বসে থাকো, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে দেবে বাপের বাড়ি চলে গেছে। গেছে কিনা তোমার ভাইকে একটা চিঠি লিখে দেখতে পারো। যাক না যাক, এখানে আর জায়গা হবে না এও পষ্ট করে জানিয়ে দিও।
এ-ঘরে বসে সবই শোনা যাচ্ছিল। বিমনার মতো কৃষ্ণকুমার আমার মুখের দিকেই। চেয়েছিল। একটা ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, ঝুমরি সেখানে যায়নি, যেতে পারে না।