রুচিরা আর কিছু বলেনি। কিন্তু ভিতরটা বিষাক্ত লাগছিল তার। অথচ এই লোকের সঙ্গে তর্ক করারও কেন যেন আর সাহস নেই।
.
রুচিরা মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল জুন মাসের মাঝামাঝি। এখানেও কংগ্রেস শাসন উৎখাত হয়ে বামজোটের দল ক্ষমতায় এসেছে। তখন সত্যিকারের আনন্দ হয়েছিল তার। দুমাস বাদে অর্থাৎ আগস্টের মাঝামাঝি কলকাতায় ফিরল। সুস্থির হয়ে দুদিন না কাটতে দাদা-বৌদির মুখে যে সুখবরটা শুনল তাতে রুচিরারও আনন্দে আটখানা হবার কথা। ইন্দ্র ব্যানার্জীর সব দিক থেকেই ভরাডুবি হয়েছে। তার বাড়িঅলা কেসে জিতেছে, কোর্ট-থেকে বকেয়া ভাড়া মিটিয়ে দেবার হুকুম হয়েছে। তার ওপর। বাড়ি ছাড়ার কেস ঝুলছে। এদিকে নতুন সরকার তহবিল তছরুপের অভিযোগে তাকে থানায় টেনে নিয়ে গেছে। আগের সরকারের আমলে চল্লিশ হাজার টাকা সে তার কেমিক্যাল কারখানা সম্প্রসারণের জন্য পেয়েছিল। বলা বাহুল্য, সেটা তখনকার সময়ের। ধরা-করার ব্যাপার। কিন্তু এখন ধরা পড়েছে, সে টাকার এক পয়সাও সেই কারখানায়। যায়নি, কারখানার বাকি অর্ধেকের মালিক সেই টাকাপ্রাপ্তির ব্যাপার স্রেফ অস্বীকার করছে। এবং সেও পার্টনারশিপ বাতিলের ব্যবস্থা পাকা করে এনেছে, কারণ, সেখানেও ইন্দ্র ব্যানার্জীর নামে বহু টাকা ব্যক্তিগত ধার হিসেবে লেখাপড়া করা আছে। তাতে ইন্দ্র ব্যানার্জীর সইও আছে। অনেক তদবির-তদারক করে সে এখন জামিনে খালাস আছে! কিন্তু সুদ-সহ ওই চল্লিশ হাজার টাকা সরকারকে বুঝিয়ে দিতে না পারলে তার জেল অনিবার্য। চল্লিশ হাজার দূরে থাক, চল্লিশ টাকা বার করারও তার মুরোদ নেই এখন।
শুনে সকলে ছেড়ে মা পর্যন্ত খুশী। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। খুশী রুচিরাও হতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোথায় যেন একটা কাটা খচখচ করে বিধছে। শঙ্কর চ্যাটার্জীর সেই হাসি-হাসি মুখ আর ঝকঝকে দুটো চোখ আর তার কথাগুলো চেষ্টা করেও মন থেকে তাড়াতে পারে না। আগেও ওই মুখ ওই চোখ আর ওই সব কথা বার। বার সামনে ভিড় করে এসেছে। কিন্তু রুচিরা আর কিছু ভাবতে চায় না, সে-সব। মন থেকে ঠেলে সরিয়েছে।
এখন আর তাও পারছে না।…শঙ্কর চ্যাটার্জী বলেছিলেন, একটা বছরের মেলামেশার মধ্যে ওর চোখে পড়া মনে ধরার মধ্যে কিছু ছিলই–সেটা মিথ্যে হতে পারে না…বলেছিলেন, তুমি সোনার মেয়ে, সোনা গলিয়ে গয়না করা যায়, আবার ডাণ্ডা বানিয়ে তা দিয়ে ঘা দিলেও আঘাত লাগে, আমি ভাবছি অভিমান-বশে সে-রকম কোনো ভুল হয়ে গেল কিনা।
…তিনি বলতে চেয়েছিলেন, সোনার স্পর্শ দিয়ে তার মন্দটা তুমি দূর করতে পারলে না কেন।
রুচিরা ভাবতে চায় না। কিন্তু ভাবনা আসছেই। আসছেই। তিনি বলেছিলেন, ভালটুকু স্বীকার করার আর ভালটুকু বড় করে তোলার এমনি জোর যে সেটা পারলে এখনো তোমার সবশেষ হয়ে গেল আমি ভাবি না।
…কিন্তু কি শেষ হয়ে গেল ভাবেন না তিনি? রুচিরার তাতে মনের প্রসারতা বাড়বে? আর কিছু না হোক শান্তি আসবে? ওই নির্মম দাম্ভিক লোকের মধ্যে ভাল দেখার মতো কি আছে? কি ছিল?
চকিতে এক অদেখা বিধবা মায়ের মুখ যেন চোখে ভেসে উঠল তার। এর বান্ধবীর সে পিসিমা। যার ছেলেকে হত্যা করার জন্য গাড়িতে তুলে নিয়ে পালিয়েছিল। একটি লোক নিজের প্রাণের ভয়-ডর বিসর্জন দিয়ে বেপরোয়ার মতো সেই দুষ্কৃতকারীদের আড্ডায় হানা দিয়ে অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে সেই বিধবা মায়ের ছেলেকে উদ্ধার করেছে …জলপাইগুড়ির বন্যায় ত্রাণের সাহায্য করতে গিয়ে নিজের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে একটি অতি-বৃদ্ধ প্রাণকে জীবনের আলোয় ফিরিয়ে এনেছে। …অসুখে বস্তির এক গরিব বন্ধুর প্রাণের আশংকা দেখা দিতে ব্যাকুল হয়ে ছুটে এসে বাবাকে প্রায় হুমকি দিয়েই ধরে নিয়ে গেছে চিকিৎসার জন্য। তারপর সেই অসুস্থ বন্ধুর মায়ের হাতে থেকে টাকা গুঁজে দিয়ে আসতে দেখে ফিরে এসে বাবা পর্যন্ত বলেছিলেন, লোকটার দরাজ অন্তঃকরণ সন্দেহ নেই…নিজের বাপের মৃত্যুতে ওই দাপটের লোককে বাচ্চা ছেলের মতো মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে দেখেছে রুচিরা নিজের চোখে।
..শঙ্কর চ্যাটার্জী এ আপনি আমার কি করে দিলেন? এখন আমি কি করব?
দুদিন পরে। গাড়ি করে দিদির বাড়িতেই যাচ্ছিল রুচিরা। ওই বাড়ির গেটের দিকে চোখ পড়তেই বুকের তলায় একটা অদ্ভুত মোচড় দিয়ে উঠল তার। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। পরনে আধময়লা পা-জামা, গায়ে আধময়লা গেঞ্জি। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। বিবর্ণ মুখ।
রুচিরা দেখল।
সেও দেখছে। ক্রুর খরখরে চাউনি।
গাড়িটা গেট পেরিয়ে যেতেই রুচিরা ড্রাইভারকে বলল, থামো!
গাড়ি থামতে নেমে এল। কাছে এল।
ইন্দ্র ব্যানার্জী এ-রকমটা ভাবেনি। চেয়ে আছে। চোয়াল দুটো এঁটে বসছে।
রুচিরা শান্ত মুখে বলল, আমি দুমাসের ওপর এখানে ছিলাম না। তোমার শরীর তো খুব খারাপ হয়ে গেছে দেখছি।
–তোমার আনন্দ হচ্ছে না?
–না।
–বল কি? কেন?
— কারণ, আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম।
হঠাৎ যেন একটু আশার আলো লাগল ইন্দ্র ব্যানার্জীর বিবর্ণ মুখে। তবু। অবিশ্বাসভরে বলল, এখন? অনুকম্পার দরুন গাড়ি থেকে নেমে এলে?
-না, এখনো তোমার ভালই চাই।
—ভাল চাও? সত্যি তুমি ভাল চাও?
মুখের দিকে পরিষ্কার চেয়ে রুচিরা মাথা নাড়ল। চায়।