মা শঙ্কর চ্যাটার্জীর ঘর চেনেন। ওকে নিয়ে সোজা সেদিকে চললেন।
ভদ্রলোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একমুখ হেসে এগিয়ে এসে সমাদরে ওদের ঘরে নিয়ে এলেন। পরিচ্ছন্ন ঘর। দেয়ালে কোনো দেবদেবীর ছবি নেই। কাঠের চৌকির ওপর পাতলা শয্যা বিছানো। সামনে খান-দুই মোড়া।
মা রুচিরাকে বললেন, প্রণাম কর
রুচিরা বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে গেল। ওই ঝকঝকে চোখে চোখ পড়তে ভদ্রলোক হেসেই বললেন, কেন ওকে ব্যস্ত করছেন মাসিমা-আপনি বরং আশ্রমটা একটু ঘুরে টুরে দেখে আসুন, অনেক দেখার আছে–আমি ততক্ষণ দিদির সঙ্গে একটু গল্প করি।-বোসো দিদি, তুমি বোসো
দিদি শুনেই রুচিরার মনে হল মানুষটি যেন ওর মনের তলার কোনো সংশয়ের জবাব দিলেন। মা কিছু একটা আশা নিয়েই আশ্রম দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।
রুচিরা তাকাল তার দিকে। সেই ঝকঝকে চোখ। হাসছেন। কিন্তু আপনা থেকেই এখন সমস্ত সংকোচ ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে রুচিরার। মানুষটির চোখে মুখে হাসিতে যেন জাদু আছে। অদ্ভুত ভাল লাগছে।
এগিয়ে এসে প্রথমে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল, তারপর মোড়ায় বসল।
চৌকিতে বসে শঙ্কর চ্যাটার্জী বললেন, তোমার মায়ের মুখে সব শুনলাম। বড় দুঃখের কথা। ভাল ভাবে এম. এ. পাস করেছ শুনলাম; কোনো মেয়ে-কলেজে কাজ-টাজ দেখে নাও না।
হঠাৎ একটু আগ্রহ নিয়েই রুচিরা বলল, আপনাদের এই সব জায়গায় আমরা কোনো কাজ-টাজ করতে পারি না?
হেসে বললেন, পার, কিন্তু তাতে অন্যের কাজ পণ্ড হবে।
–কেন? মেয়ে বলে?
শঙ্কর চ্যাটার্জী হাসিমুখে মাথা নাড়লেন। তাই।
এই সংস্রবে এটুকু সময়ের মধ্যে রুচিরা প্রায় মুখরা হয়ে উঠল কি করে জানে না। বলল, সাধুরা তাহলে কিরকম সাধু?
হাসছেন।–শরীর ধরলে কেউ সবটা সাধু নয়, আবার সবটা অসাধু নয়। যখন যার চাষ হয় সে বাড়ে। খাঁটি দুধও জলে ফেললে মিশে যায়, মাখন তুলে সেটা ফেললে জলে ভাসে। সাধুদের বেশির ভাগ মাখন হতে চাইছেন, হননি এখনো। হলে পরে ভয় থাকে না।
সহজ কথা। কিন্তু নিগূঢ় তাৎপর্য আছে। রুচিরা তবু ফস করেই জিজ্ঞাসা করে। বসল, আপনার কোন অবস্থা?
জোরেই হেসে উঠলেন শঙ্কর চ্যাটার্জী। বললেন, তুমি বড় সাদা মনের ভাল মেয়ে দিদি, তোমার এরকম বরাত হবার কথা নয়। আমি একটা রক্ত-মাংসের মানুষের ঢেলার বেশি কিছু নয়।
-রক্ত-মাংসের মানুষ হলে কেউ মাকে ছেড়ে পালায়?
হাসতে লাগলেন। তারপর বললেন, এটা একটা নেশা। নেশায় পেয়ে বসলে কে আর বাপ-মা মানছে?
এই মানুষ নিজের প্রসঙ্গে কিছু বলবেন না রুচিরা বুঝে নিল। কিন্তু সত্যি ভাল লাগছে তার, হালকা লাগছে। বলল, মায়ের খুব বিশ্বাস আপনি আমার জন্য কিছু করতে পারেন, কিছু দৈব অনুগ্রহও পাইয়ে দিতে পারেন।
হেসে মাথা নাড়লেন।-না, আমি সে রকম ম্যাজিক কিছু জানি না।
-না জানলে আমার বিয়ে সুখের হল না, গঙ্গার ঘাটে আমাকে দেখেই সে কথা বললেন কি করে?
এবারে অবাক একটু। তার পরেই আবার হাসি।–ও, এই জন্যে তোমরা একটা কিছু ভেবে বসে আছ? বছর তিন সাড়ে তিন আগে মাকে দেখতে যখন কলকাতায় গেছলাম, এক রাস্তায় তোমার দাদা সঞ্জয়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা আমার। সে চেনেনি, আমি চিনেছি। তাকে খবর জিগেস করতে সে বলেছিল, তোমাদের দু বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। তা আমার পোশাক-আশাক দেখে সেও আমাকে তোমার মতোই ভণ্ড-টণ্ড কিছু ভেবে সরে গেছল। তেমন পাত্তা দেয়নি।
মানুষটার সরলতা দেখে রুচিরা মুগ্ধ হল, আবার লজ্জাও পেল একটু। সরল না হলে বিয়ে সুখের হল না বলার কৃতিত্বটুকু নিজেই নিত। আর লজ্জা পেল কারণ, গঙ্গার ঘাটে প্রথম দেখে সত্যিই অস্বস্তি বোধ করেছিল। তবু জিজ্ঞাসা করল, দাদার মুখে বিয়ের খবর শুনতে পারেন, কিন্তু সুখের হল না জানলেন কি করে?
-এটা জানা যে সহজ সে এখন তুমি নিজে ভাবলেই বুঝতে পারবে। যাক, তোমাকে আমার বড় ভাল লেগেছে দিদি, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
রুচিরা আবার কেন একটু অস্বস্তি বোধ করছে জানে না। মাথা নাড়ল।
-তোমার মত মেয়েও একটা লোককে ধরে রাখতে পারল না, ফেরাতে পারল না, এটা ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছে। কেন পারলে না? চেষ্টা করেছিলে?
রুচিরার ভিতরটা হঠাৎই তেতে উঠল।–তাকে জানলে আপনি এ কথা বলতেন না।
শঙ্কর চ্যাটার্জী চুপ করে রইলেন। কিন্তু মুখ দেখে মনে হল ঠিক অনুমোদন করতে পারলেন না যেন।
-আপনার বিশ্বাস হল না?
–না।
রুচিরা প্রায় তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠল, কেন? আপনি তার কতটুকু জানেন?
-একটুও জানি না। শান্তমুখেই বললেন, কিন্তু সামনা-সামনি কাউকে দেখলে আমি তার অনেকটা ভেতর দেখতে পাই। তাছাড়া তোমার মায়ের কাছেও অনেক কথা শুনেছি।…তুমি সোনার মেয়ে। সোনা গড়িয়ে গহনা করা যায়, আবার ডাণ্ডা বানিয়ে তা দিয়ে ঘা দিলেও আঘাত লাগে। আমি ভাবছি সে-রকম কোনো ভুল হয়ে গেল কিনা।
কথাগুলি সুন্দর, কিন্তু একটা দুর্বল জায়গায় আবার ঘা পড়ল রুচিরার। বলল, আপনি তাকে জানলে এ-কথা একবারও বলতেন না।
এখন আর হাসছেন না। ঝকঝকে চোখ দুটো ওর মুখের ওপর আটকে আছে। বিয়ের আগে ইন্দ্রর সঙ্গে কতদিন মিশেছিলে?
নামটা মায়ের কাছে শুনে থাকবেন। জবাব দিল, এক বছর।
-এই এক বছরে তার মধ্যে যা দেখে তোমার ভাল লেগেছিল, যা দেখে তাকে তুমি ভালবেসেছিলে–সেটা মিথ্যে হতে পারে না। তোমার চোখে পড়া মনে ধরার মতো তার মধ্যে কিছু ছিলই–সেও মিথ্যে হতে পারে না। একটু আগে তোমাকে বলছিলাম, শরীর ধরলে কেউ সবটা ভাল নয়, আবার সবটা মন্দও নয়, যখন যেটা চাষ হয় সেটা বাড়ে। তুমি ভালটা দেখেছিলে, মন্দটা দেখনি। সেই মন্দের ছায়াটা দূর করতে হলে অহংকার আর অভিমান ছেড়ে তারই ভালর আলোটুকু সব থেকে জোরালো করে তুলতে হয়। আমার ভুল হতে পারে, তোমার অভিমানে ধা পড়েছিল কিনা সে আমার থেকে তুমিই ভাল জান। এর পরেও তুমি তার মন্দটাই যদি একমাত্র সত্যি বলে ভাবো তাহলে তার আরো দুর্ভাগ্য, তোমারও আরো বেশি অশান্তি। কিন্তু ভাল স্বীকার করার আর ভাল বড় করে তোলার এমনি জোর যে সেটা পারলে এখনো তোমার সব শেষ হয়ে গেল আমি ভাবি না। কোনো কিছুরই শেষ বলে কিছু নেই।