লোকটার গায়ের জোর কখনো পরখ করে দেখার সুযোগ হয়নি। তবে দেখলেই মনে হত অসুরের শক্তি রাখে। ঝুমরি উসকে দিলে আমাদের ধড় থেকে মাথা ছিঁড়ে নেওয়াও ওর পক্ষে অসম্ভব নয় হয়তো। মিশকালো গায়ের রঙ। খুব লম্বা নয় আবার বেঁটেও নয়। এক মাথা ঝাকড়া চুল, ড্যাবডেবে দুটো চোখ। সে-চোখে পলক পড়তে দেখা যায় না বড়। মুখের দিকে চেয়ে থাকলে অস্বস্তি হয়। ওর মধু নাম একটা বিতিকিচ্ছিরি রসিকতা যেন।
ওর আসল কাজ কবিরাজির মালমশলা সংগ্রহ করা আর ওষুধ বানানোর ব্যাপারে কৃষ্ণকুমারের বাবাকে সাহায্য করা। বনবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে ওষুধের শিকড়-বাকড়, লতাপাতা, ফলমূল যোগাড় করে আনে। কোন জিনিসগুলো মনিবের বেশি দরকার এ ক বছরে ভালই বুঝে নিয়েছে। ওর অপলক ড্যাবডেবে চাউনির কথা উঠলে কৃষ্ণকুমার হেসে বলত, ওর চোখ আছে, বাবা একবার যা ওকে দেখিয়ে দেয় সহজে ভোলে না। ঠিক চিনে নিয়ে আসে। কৃষ্ণকুমারের বাবা শুধু বিচক্ষণ নয়, টাকা-কড়ির ব্যাপারেও বেশ একটু হাত-টান আছে। তা সত্ত্বেও ভদ্রলোক সেই দিনে খাওয়া পরার ওপরে মাসে চল্লিশ টাকা মাইনে কেন ওকে দেন সেটা আঁচ করা যেত। বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মধু যা সংগ্রহ করে আনত সে-সব আর বাজার থেকে কিনতে হত না। ফলে অনেক সাশ্রয় হত। তারপর সেসব বাছাবাছি করে ধুয়ে শুকিয়ে গুঁড়িয়ে পিষিয়ে কবিরাজ মশায়ের হাতের কাছে এনে মজুত করা কম ধকলের ব্যাপার নয়। কিন্তু মধু যাদব অনায়াসেই তা করত। যেন কলের মানুষ একটা যন্ত্রের মতোই খাটতে পারে।
এ-হেন মানুষের একটু রসজ্ঞানের পরিচয়ও আমরা পেতাম, আর নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতাম। সুলক্ষণা বা ঝুমরির গানের গলাটি ভাল ছিল। যেমন লোকই হোক, গান-বাজনার প্রতি ঝোঁক ছিল ওর বাবার। মাস্টার রেখে মেয়েকেও একটু আধটু। শেখাতে চেষ্টা করেছিল। এখানে আসার পর কৃষ্ণকুমার সে-ব্যবস্থা বাতিল হতে দেয়নি। সামান্য মাইনেয় তার খাতিরের এক বুড়ো ওস্তাদের বাড়ি গিয়ে ঝুমরি গান শিখত। মাঝে মাঝে ওস্তাদও বাড়িতে আসতেন। কৃষ্ণকুমারের বাবা ওই কটা টাকাই বাজে খরচ ভাবত। কিন্তু ছেলের ব্যবস্থা নাকচ করার সাহস তার ছিল না। এই গান শেখার ব্যাপারেও ঝুমরির খুব যে একটা নিষ্ঠা ছিল তা নয়। তবে ওর গলা মিষ্টি, আর গানের ঢংটুকু আমার চোখে অন্তত আরো মিষ্টি। মেজাজ এসে গেলে গান গাইতে গাইতে অল্প অল্প দুলত, কালো চোখের গভীরের হাসির ছোঁয়াটুকু তখন অদ্ভুত মায়াচ্ছন্ন মনে হত। ঝুমরির গানের সব থেকে সেরা আর নারব ভক্ত ছিল বোধকরি মধু যাদব। বাইরের অন্ধকার দাওয়ায় একখানা পাথরের মূর্তির মতো চুপচাপ বসে থাকত। যতক্ষণ গান চলত ওর নড়াচড়া নেই। সে-সময় কেউ কোনো কাজের ফরমাশ করলে ও একদম কালা বনে যেত। নেহাত বাড়ির কর্তা বা কর্তীর ডাক না পড়লে দাওয়া থেকে ওকে নড়ানো যেত না। আগে শুনেছি, ঝুমরির গানের সময় ও নাকি দরজার সামনেই এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। ঝুমরি নিষেধ করার পর আর দাঁড়ায় না। নিষেধ না করে উপায় কি, চোখের ওপর ও-রকম সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকলে ঝুমরির হাসি পেয়ে যায়।
ঝুমরি বাড়ি থেকে নিখোঁজ হবার মাত্র তিন সপ্তাহ আগে এই মধু যাদবকে বাড়ি থেকে তাড়ানো হয়েছিল। তার আগে দস্তুরমতো থানা পুলিস করা হয়েছিল ওকে নিয়ে। চুরির ব্যাপার। ঝুমরির হার চুরি। সে-চুরি ঝুমরি বলতে গেলে স্বচক্ষেই দেখেছে। ওর মায়ের হার। মায়ের স্মৃতি। ওটার ওপর যে ঝুমরির অত মায়া জানতাম না। আমার ধারণা মধুকে তলায় তলায় একটু স্নেহই করত ও। কিন্তু হার খোয়া যাওয়া আর প্রায় হাতে-নাতে ধরা পড়ার পরেও মধুকে অস্বীকার করতে দেখে ঝুমরি রাগে ঠক ঠক করে কাঁপছিল। দু চোখে আগুন ছুটেছিল। বাথরুম থেকে সবে স্নান সেরে বেরিয়েছে। হারটা খুলে তাকের ওপর রেখেছিল। ওটা ফেলে এসে নিজের ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চোখে পড়েছে গলায় হার নেই। তক্ষুনি আবার ফিরে আসতে দেখে বাথরুমে মধু কলের নিচে বালতি বসিয়েছে। মনিবের স্নানের জল রোদে দেবে। বাথরুমের দোরগোড়া থেকেই ঝুমরি দেখে তাকের ওপর হারটা নেই। ধরেই নিল, হার পড়ে আছে দেখে মধু তাকে দেবার জন্যেই নিয়েছে ওটা। হাত বাড়িয়ে বলেছে, দাও
জবাবে মধু ড্যাব ড্যাব করে মুখের দিকে চেয়ে রইল শুধু।
বিরক্ত হয়ে ঝুমরি আবার বলেছে, কি হল, হারটা দাও?
এবারে মধু নিজে থেকেই ঘুরে দেয়ালের তাকটা দেখেছে। তারপর তার দিকে ফিরেছে। আবার অপলক চাউনি, মুখে কোনো রকম ভাববিকার নেই।
ঝুমরিকে সহিষ্ণু মেয়ে কেউ বলবে না। ঝাঁঝিয়ে উঠল, হাঁ করে দেখছ কি চেয়ে, ওই তাক থেকে তুমি হারটা তোলোনি?
মধু মাথা নেড়েছে। তোলেনি।
আর যায় কোথায়। ঝুমরির মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে চেঁচিয়ে উঠল, চালাকি পেয়েছ? এক মিনিট হয়নি, আমি ঘরে গেছি আর এসেছি, এর মধ্যে তুমি ছাড়া আর এখানে কে ঢুকেছে? হারটা আকাশে উড়ে গেল? ভাল চাও তো এক্ষুনি দিয়ে দাও!
মধু আবার মাথা নাড়ল। সে নেয়নি, অথবা সে কিছু জানে না।
ক্ষিপ্ত হয়ে ঝুমরি পিসির কাছে ছুটল। বাড়িতে এ-সময় ঝি-চাকর কেউ নেই। এর মধ্যে একমাত্র পিসী যদি বাথরুমে ঢুকে থাকে আর হার তুলে থাকে। যদিও জানে তা হতে পারে না, কারণ পিসী তখন রান্নায় ব্যস্ত। মোটা শরীর নিয়ে তার রান্নাঘর থেকে এ-পর্যন্ত আসতেই দু-চার মিনিট লাগার কথা।