কিন্তু বি. এ. পরীক্ষা দিয়ে সত্যিই আর সে ঘরে থাকল না। দু-লাইনের এক চিঠিতে মাকে তার জন্য ভাবতে বারণ করে কোথায় যে চলে গেল কেউ জানে না। ভালমানুষ উমাদির অনেকগুলো মেয়ে আর ওই একটাই ছেলে। সে পাগলের মতো হয়ে গেল। এর বছর দেড়েকের মধ্যে রুচিরার বাবা-মা ও-বাড়ি ছেড়ে অন্য বড় বাড়িতে উঠে আসেন। আরো বছর দুই-তিন যাতায়াত ছিল। কিন্তু তখনো উমাদি ছেলের কোনো খবর পায়নি। এরপর রুচিরার বাবা এখনকার এই বাড়ি করে উঠে আসেন। তারপর থেকে আর যোগাযোগ ছিল না।
রুচিরার মায়ের মনে কি আশা কে জানে। পরদিনই বিকেলে সেই মিশনের উদ্দেশ্যে ছুটলেন। রুচিরার সঙ্গে না গিয়ে উপায় নেই। মাকে একলা ছেড়ে দেওয়া যায় না। দেড় মাইলের মধ্যে সেই মিশন। টাঙ্গাঅলাকে বলতে সে-ই নিয়ে গেল। বিরাট এলাকা, বিশাল ব্যাপার। সেখানে সাধন-ভজন ছাড়াও সেবাব্রত একটা বড় কাজ বোঝা গেল। ভিতরে ডিসপেনসারি, হাসপাতাল। পয়সা দিয়ে পড়তে পারে না এমন। ছেলে-মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা-ব্যবস্থাও আছে।
ঝকঝকে মস্ত একটা হলঘরে বক্তৃতার আসর বসেছিল। শঙ্কর চ্যাটার্জীর খোঁজ করতে ওদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। অনেক বিদেশীর সমাগম ঘটেছে সেদিন। আর বহু গেরুয়া-পরা সাধুও বসে। বিদেশাদের কারণেই হয়তো ইংরেজিতে বক্তৃতা করছেন শঙ্কর চ্যাটার্জী। বিশুদ্ধ উচ্চারণ বলার সাবলীল ভঙ্গি। সকলে একাগ্র মনে শুনছেন। ধর্মীয় দর্শনের কিছু একটা ব্যাখ্যা চলেছে। রুচিরার ভাল লাগছে। কান। পেতে শুনতে এবং বুঝতে চেষ্টা করল সেও।
বক্তৃতার পরে মা সেদিন আর তাকে নিরিবিলিতে পেলেন না। কারণ এর পরেই তার অন্যত্র কোথায় যাবার কথা। তবু হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়ালেন একটু। মায়ের সঙ্গে পাঁচ-সাত মিনিট কথা বললেন। রুচিরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে। বার কয়েক ওকেও ঘুরে দেখলেন তিনি। কিন্তু রুচিরার সেই আগের দিনের গঙ্গার ঘাটের মতোই অস্বস্তি। তাকালেই ভদ্রলোক যেন বড় বেশি দেখতে পান। পুরুষের এই দেখাটাকে রুচিরা খুব যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারে না।
পরদিন সকালে টাঙ্গা নিয়ে মা একলাই চলে গেলেন সেখানে। রুচিরাকে ডাকতে সে স্পষ্ট বলে দিল তার ভাল লাগছে না। ঘণ্টা দুই বাদে মা ফিরে ওই লোকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সকালেও উনি কোথায় চলে গেছলেন বলে মায়ের ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সেই সময় এক বুড়ো সাধুর সঙ্গে মায়ের অনেক কথা হয়েছে। তাঁর মুখে মা শুনেছেন, শঙ্কর চাটুজ্যে সাধু-টাধু কিছু নন কিন্তু এখানকার সব সাধুরাই তাকে বিশেষ ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। তারা তাকে পরম সমাদরে ওখানে রেখেছেন, কখন হুট করে আবার চলে যান সেই ভাবনা সকলের। ভদ্রলোক টানা ষোল বছর বিদেশে কাটিয়েছেন। পৃথিবীর বহু জায়গায় ঘুরেছেন। এই আশ্রমের সঙ্গে তার যোগ পাঁচ বছরের, তার মধ্যেও দু-বার কাউকে কিছু না জানিয়ে একবার এক বছর আর একবার ন-মাসের জন্য কোথায় চলে গেছলেন। আধ্যাত্ম জগতের শিক্ষিত মানুষেরা এখানে। এলে তার কথা, তার ব্যাখ্যা শোনার জন্য ছুটে আসেন। সেই জন্যেই সপ্তাহে একদিন করে এক একটা বিষয়ের ওপর তার বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। আগের দিন সেই বক্তৃতাই তারা শুনে গেছল। অন্যান্য দিন এখানকার সাধুদের তিনি এক ঘণ্টা দু ঘন্টা করে দেশ-বিদেশের দর্শনশাস্ত্র পড়ান। সাধুরাও তাকে তেমনি ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন।
এর পর শঙ্কর চ্যাটার্জীর সঙ্গে মায়ের দেখা হয়েছে, এক ঘণ্টা ধরে অনেক কথা হয়েছে। তার কথা শুনলে নাকি কান-মন জুড়িয়ে যায়। মায়ের মুখখানা আনন্দে বিহ্বল। ঠিক কোন প্রত্যাশায়, রুচিরা ঠাওর করতে পারল না। মা যে গলগল করে ওই লোকের কাছে মেয়ের সর্ব দুর্ভাগ্যের কথা বলে এসেছেন তাতেও কোনো সন্দেহ। নেই। ওর প্রসঙ্গে উনি নাকি হেসেই মাকে বলেছেন, আপনার মেয়ে আমাকে ঠিক পছন্দ করতে পারছে না তাই আসেনি।
রুচিরা কেন যেন তেতে উঠল হঠাৎ।–কি-রকম পছন্দ করতে হবে তাকে?
মা থতমত খেলেন। তারপর ধমকের সুরে বললেন, মহাপুরুষদের নিয়েও কি ভাবে যে কথা বলিস ঠিক নেই। বিকেলে তোকে নিয়ে যাব বলেছি।
-কেন? মহাপুরুষদের কাছ থেকে কি আশা কর তুমি? কি করবেন?
মা জবাব দিলেন, কেন রাগ করিস বুঝি না। মায়ের ভাবনা জানিস না?…এরা কত কি দেখতে পায়, বোঝে, হয়তো তোর ভাল হবে এমন কিছু বলে দেবে–নইলে এদের কাছে মানুষ ছুটে ছুটে আসে কেন?
রুচিরা আর কিছু বলল না। নিজের জ্বালায় রাগ করে। নইলে ওই লোকটি সম্পর্কে মায়ের মুখে শোনা বৃদ্ধ সাধুর কথাগুলো ভারি ভাল লেগেছে। সেদিনের। বক্তৃতার অংশ মা হয়তো বোঝেনি, কিন্তু যেটুকু শুনেছে তাতেই ওর মনে দাগ পড়েছে। অসাধারণ কিছু আছেই ওই লোকের মধ্যে, নইলে এ-ভাবে কেউ জীবন কাটাতে পারে না। আশ্চর্য, আজ সেখানে যাবার জন্য দুপুর থেকে ও নিজেই কিরকম একটা তাগিদ অনুভব করছে। ওই লোকের চোখ দুটোকে কেমন ভয়-ভয় করে, আবার। টানেও যে খুব সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
বিকেলে একটুও আপত্তি না করে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। আশ্রমের। আঙিনায় পা ফেললে মনটা আপনা থেকে খুশী হয়। এখানে-ওখানে পরিচ্ছন্ন বাগান। গাছ-গাছড়া। মালি কাজ করছে, সঙ্গে দু-চার জন সাধুও। অদূরের হাসপাতালের দিকে সাধু আর লোকজনের যাতায়াত বেশি। এই পরিবেশের ভারী একটা আকর্ষণ আছে।