প্রথম দেখা হর কী পিয়ারীর ঘাটে। জনাকতক আধবয়সী মেয়ে-পুরুষ ঘিরে। দাঁড়িয়েছিল তাকে। হাত নেড়ে হাসিমুখে তিনি সামনের আছাড়ি-পিছাড়ি গঙ্গাকে দেখিয়ে কি বলছিলেন। এর মধ্যে নতুন যারা আসছে তারা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে। তাকে। কে প্রণাম করছে না করছে ভদ্রলোক তাও খেয়াল করছিলেন না।
মায়ের সঙ্গে একটু দূরের উঁচু ধাপে দাঁড়িয়েছিল রুচিরা। কথা বলতে বলতে মানুষটির হঠাৎ এদিকে চোখ পড়ল। দূর থেকেও রুচিরার মনে হল চোখ দুটো ভয়ানক ঝকঝকে। আর তার থেকে যেন একটু হাসির আভাস ছিটকে বেরোয়। রুচিরা অন্য দিকে মুখ ফেরাতে যাচ্ছিল। কিন্তু এবারে মনে হল অপলক চোখে ভদ্রলোক এখন মাকে দেখছেন। তাকে ঘিরে যারা ছিল, এই দেখাটা তাদেরও চোখে পড়েছে। তারাও এ-দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে।
তাদের সরিয়ে মানুষটি হঠাৎ এদিকে আসতে লাগলেন। রুচিরা ভেবে পেল না কি ব্যাপার। কাছে এসে হেসে মাকে বললেন, মাসিমা, চিনতে পারেন?
মা হকচকিয়ে গেলেন। দূর থেকে আগে মা-ও একে দেখেছেন আর মস্ত কোনো সাধু-টাধু ভেবে বসেছিলেন। মাসিমা ডাক শুনে তার হতচকিত হবার কথাই।
উনি হেসে বললেন, চিনতে পারলেন না তো, আপনাদের কলকাতার সেই উমাদিদির ছেলে শঙ্কর–মনে পড়ছে না?
মায়ের সমস্ত মুখে যে বিস্ময়ের আঁচড়গুলো পড়তে থাকল রুচিরা তা ঠিকই লক্ষ্য করছে। মা যেন ঠিক ধরতে-ছুঁতে পেরেও পারছেন না। তারপরেই মনে পড়ল। ব্যগ্র মুখে বললেন, সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী রোডের আমাদের পিছনের বাড়ির উমাদি? উমা চ্যাটার্জী?
হেসে মাথা নাড়লেন।-এবারে চিনেছেন? দেয়াল টপকে আপনাদের বাড়ি গিয়ে কত দৌরাত্ম করেছি, যখন-তখন খেতে চেয়েছি, মনে পড়ে? আমি তো এই বাইশ বছর বাদেও আপনাকে দেখেই চিনে ফেললাম।
মায়ের মুখখানা যেন হঠাৎ ব্যাকুলতায় ভরে গেল একেবারে।-হ্যাঁ বাবা চিনেছি। –কিন্তু তুমি এখানে আছ, উমাদি জানেন? তুমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছ? উমাদি কি এখনো ঈশ্বর গাঙ্গুলী রোডের সেই বাড়িতেই আছেন?
মানুষটি হাসছেন। চোখ দুটো আশ্চর্য ঝকঝকে বটে। একবার রুচিরার দিকে তাকালেন। মনে হল ওই দুটো চোখের,একটা বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বুঝি গায়ে এসে লাগল। হঠাৎ কেন যে একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল রুচিরা জানে না।
-মা দুবছর আগেই গত হয়েছেন। আমি তখন বাইরে। আর সব ও-বাড়িতেই। আছেন।
ব্যাকুল মুখে মা বলে উঠলেন, সেই বিশ বছর বয়সে ঘর ছেড়ে চলে গেছলে, এতকালের মধ্যে তোমার মায়ের সঙ্গে আর দেখাই হল না?
–মা মারা যাবার সময় আমি তার কাছেই ছিলাম।
রুচিরার মনে হল তার মা যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। একটা ব্যাপারে একটু অবাকই লাগল। মা বলছেন বিশ বছর বয়সে ঘর ছেড়েছে, আর ইনি একটু আগে বললেন, বাইশ বছর বাদেও দেখেই মাকে চিনেছেন–মানুষটির বয়েস কি তাহলে বাইশ আর কুড়ি বিয়াল্লিশ এখন? মুখ দেখলে এর কাছাকাছি মনে হয় না।
রুচিরার মা বললেন, যাক, তবু তাহলে মাকে শেষ সময়ে শান্তি দিতে পেরেছ। একটু। বলা নেই কওয়া নেই, বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে আর উমাদি একেবারে পাগলের মতো হয়ে গেল–দেখে আমাদের চোখে জল আসত। মাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে কি যে পুণ্য হয় আমি বুঝি না।
হাসিমুখেই মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক। বললেন, পুণ্য হয় না।
তার পরে ঘুরে তাকালেন রুচিরার দিকে। গভীর, একেবারে ভেতর দেখে নেবার মতো চাউনি। এমন যে, রুচিরার মনে হতে লাগল গায়ে যেন যথেষ্ট আবরণ নেই। একটু বাদে মায়ের দিকে ফিরলেন আবার। জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়ের বিয়েটা বুঝি সুখের হল না?
শোনার সঙ্গে সঙ্গে রুচিরা চমকেই উঠল। মাও প্রথমে হতভম্ব, তারপরে ব্যাকুল।–তুমি দেখে বুঝলে বাবা? তুমি সেই শঙ্কর–না কোনো মহাপুরুষ তুমি?
হাসছেন।–আমি মহাপুরুষ-টুরুষ কিছু নই মাসিমা।
-না না। ও-সব আমি শুনছি না, তুমি সব জান, সব বুঝতে পার, নইলে তুমি জানলে কি করে? তুমি বল ওর কি হবে? ওর অদৃষ্টে কি আছে? ওর কথা ভাবলে আমার প্রাণটা একেবারে শুকিয়ে যায়।
এর মধ্যে একজন লোক এসে তার কানের কাছে মুখ এনে কি বলতে মাথা নেড়ে তিনি আবার মায়ের দিকে ফিরলেন।–আপনি বিশ্বাস করুন মাসিমা, আমি কিছু জানি না, ও-সব বিদ্যে আমার নেই। আমার ওখানে একদিন এলে খুশী হব। মিশনে লোক এসেছেন, এখন আমি যাই
মিশনের নাম এবং হদিস বলে দিয়ে চলে গেলেন।
মা ব্যাকুল চোখে সেদিকে চেয়ে রইলেন।
.
ধরমশালার তিনতলায় একটা সুইট ভাড়া করে মাকে নিয়ে উঠেছিল রুচিরা। ঘরে ফিরে দু-চার কথায় মায়ের কাছে ব্যাপারটা শুনে নিল। উমাদি বলতে মায়ের সত্যি সম্পর্কের কেউ নয়। শঙ্করের বাবা ছিলেন উকিল, কিন্তু খুব পসার ছিল না। রুচিরার বাবা মা-ও তখন ঈশ্বর গাঙ্গুলী রোডে এক ছোট বাড়িতে থাকতেন। রুচিরার মনে থাকার কথা নয়, কারণ তার তখন মাত্র বছর তিন-চার বয়েস। সেই বাড়ির ঠিক পিছনে ছোট একটা ভাঙা পৈতৃক বাড়িতে উমাদি আর অনেকগুলো মেয়ে আর এই একটা ছেলেকে নিয়ে থাকতেন সেই উকিল ভদ্রলোক। এই ছেলেটা সত্যি খুব দুরন্ত আর খেয়ালী ছিল। রুচিরার মায়ের কাছে যখন-তখন আসত, খেতে চাইত। ওদের বিশেষ করে রুচিরাকে নিয়ে নাকি লোফালুফি খেলত। তাই দেখে রুচিরার বাবা নাকি একদিন খুব বকেও দিয়েছিলেন তাকে। শঙ্কর নিজের মাকে আর রুচিরার মাকেও এক-এক সময় বলত, বেশিদিন সে আর এ সংসারে থাকছে না–তার ভাল লাগে না। কিন্তু তার সে-কথায় কেউ কান দিত না। রুচিরার মা ভাবতেন অভাবের সংসারে ভাল খেতে পরতে পায় না বলেই এ সব কথা বলে।