শুকনো পাংশু মুখে ভদ্রলোক চলে যেতেই লজ্জায় অপমানে রুচিরা ঝলসে। উঠল।–এ-সবের মানে কি আমি জানতে চাই! এদিকে টাকা ওড়াচ্ছ, ফুর্তি করছ, আর চার মাস ভাড়া দাওনি লজ্জা করে না? নিজে দোষ করে আবার ছোটলোকের মতো ভদ্রলোকের ওপর হম্বি-তম্বি করছ?
ছোটলোকের মত শুনেই ইন্দ্র ব্যানার্জীর মাথায় রক্ত উঠে গেল। মুখের সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়াল। চোয়াল দুটো এটে বসল।–কি বললে?
–কি বললাম তুমি শোননি?
–শুনেছি। আর একবার বল তো?
–বললে তুমি কি করবে?
–একটা একটা করে ওই দাঁতগুলো খুলে নেব।
রুচিরা থমকাল। তক্ষুণি মনে হল, পারে। এও পারে।
দুপুরে সে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুচিরা নিজের ট্রাঙ্ক গোছাল। গয়নাপত্র সব বার করে নিল। তারপর একটা ট্যাক্সি ডেকে সোজা বাপের বাড়ি।
তারপর দিন গেছে, মাস গেছে, একে একে দুটো বছর ঘুরেছে। ওই এক মানুষকে নিয়ে এই বাড়িতে, এ-বাড়ির রাস্তায় অনেক ঝড় বয়ে গেছে। হুমকি শাসানি আর শেষ পর্যন্ত বোমাবাজীর ভয় পর্যন্ত দেখানো হয়েছে।
গোঁ রুচিরার বাবারও কম নয়। নামী ডাক্তার, পাঁচজন হোমরা-চোমরা মানুষ খাতির করেন তাকেও। তাদের সহায়তায় বোমাবাজীর হাত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। বাড়িতে তবু বাড়তি দরোয়ান রাখতে হয়েছে। রুচিরাকেও একলা কোথাও বেরুতে দেওয়া হয়নি।
এদিকে কেস চলেছে। জোর ও-তরফেরও কম নয়। বিচ্ছেদের মামলা আনা হয়েছিল রুচিরা স্বামীর ঘর ছাড়ার পাঁচ মাস বাদে। কোর্টের রায় বেরুতে আরো ন-দশ মাস!
সব মিলিয়ে সাতাশ মাসের একটা অধ্যায় শেষ। এর পরেও হামলা হত কিনা বলা যায় না। কিন্তু দেশের হাওয়া রাতারাতি বদলেছে। দিল্লীর শাসন-ক্ষমতা জনতার হাতে এসেছে গত মার্চের শেষে। এখানকার এতদিনের ডাকসাইটে পাণ্ডাদের মাথায়ও আচমকা বজ্রাঘাত ঘটে গেছে যেন। এপ্রিলের এই গোড়াতেই কোর্টের রায় বেরুল।
.
এক বছর বাদ গেছে, তার পরের বছরেই এম. এ. পাস করে ঘরে বসেছিল। রুচিরা। এতদিন সাহস পায়নি, এখন একটা কাজ-টাজ দেখে নেবার ইচ্ছে। নইলে সময় কাটে কি করে?
কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পর কোথা থেকে যে রাজ্যের ক্লান্তি এসে ঘেঁকে ধরেছে তাকে কে জানে। কিচ্ছু ভাল লাগে না। ওই দাপটের মানুষের এখন আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেউ আর কেয়ার করে না তাকে। শুনেছে, বাড়িঅলাও এবার তার বিরুদ্ধে কেস ঠুকে দিয়েছে।
দিদির আবার মতলব, সুশীতলের সঙ্গেই এবার তার বিয়েটা হোক। এ-পর্যন্তও সে বিয়ে করেনি। দিদি প্রায়ই বোনের মন বুঝতে আসে। কিন্তু রুচিরা কি বলবে? নিজের মনের হদিস নিজেই ভাল পায় না।
সুশীতল চক্রবর্তী নিজেই এল একদিন। রুচিরার হাঁস-ফাস দশা। কথা উঠলে কি বলবে জানে না।
কিন্তু নরম করে সুশীতল যে-কথা বলল, এ-রকমটা শোনার জন্যও প্রস্তুত ছিল। বলল, দেখ তোমার দিদির একটা মতলব টের পাচ্ছি। সেই জন্যই তোমাকে দুটো কথা বলতে এলাম, নইলে তুমি ভাববে হয়তো আমার ইচ্ছে বুঝেই তিনি এই মতলব করছেন। কিন্তু আমি তোমাকে সত্যি কথা বলছি, আমি এতে রাজী নই…আমার মতো মানুষকে ভালবাসতে পারলে তুমি আগেই বাসতে। তুমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস। করেই একজনকে ভালবেসে তার ঘরে গেছলে। যা হয়ে গেল সেটা দুর্ভাগ্য, সেটা তোমার ভালবাসার দোষ নয়। এই দুর্ভাগ্যের সুযোগ নিয়ে আবার আমি এগিয়ে এসে ভালবাসার দাবী করব–এটা বোধহয় আরো বেশি ভুল হবে। আমি বরং প্রার্থনা করব, যে ধাতের মানুষকে তুমি ভালবাসতে পার সে-রকম একজনকেই যেন পাও।
সুশীতলের কথাগুলো অনেক ভেবেছে রুচিরা। প্রতিটি কথা যে সত্যি সে আর ওর থেকে বেশি কে অনুভব করতে পারে?
ডিভোর্সের দেড় মাসের মধ্যে বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। এতবড় ডাক্তার, নিজের কোনো রকম চিকিৎসার সুযোগটুকুও দিলেন না।
রুচিরার আরো বুক ফেটে কান্না এল যখন জানতে পারল বাবা এর আগেই ওর জন্য ভবিষ্যতের কি ব্যবস্থা করে গেছেন। তাঁর উইলে বাড়ির দু ভাগ দাদা আর দিদির, একভাগ রুচিরা আর মায়ের। এ ছাড়া শুধু রুচিরার জন্য ব্যাঙ্কে রেখেছেন নগদ দু লক্ষ টাকা। না, রুচিরাকে খাওয়া-পরার ভাবনা ভবিষ্যতে কোনোদিন ভাবতে হবে না।
কিন্তু দিন-রাতই ভাবছে। বাবার কাজ-কর্ম চুকে যেতে শোকতপ্ত মাকে নিয়ে বেশ কিছুদিনের জন্য বাইরে বেরিয়ে পড়ল সে। কারণ বাবা থাকতে মায়ের মুখের একটা খেদ সে অনেকবার শুনেছে। জীবনে এ-পর্যন্ত এক কলকাতা ছাড়া আর কোনো তীর্থের জায়গা দেখা হল না। তীর্থের টান রুচিরার একফেঁটাও নেই, কিন্তু এখানে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। মা তীর্থ করুক, ওর ঘুরে বেড়ানোটাই লাভ।
কাশী মথুরা বৃন্দাবন সেরে দিল্লী হয়ে হরিদ্বারে এল তারা। ফেরার তাড়া কিছু নেই। প্রায় দুটো মাস কেটে গেছে। হরিদ্বারে দিন পনেরো থাকবে। মাঝে ঋষিকেশ লছমনঝোলা যাবে, দেরাদুন আর মুসৌরিটাও ঘুরে আসবে। রুচিরার এই ভেসে বেড়ানোর মতো ব্যাপারটা ভাল লাগছিল। তীর্থের টান থাক না থাক, প্রকৃতির সঙ্গে বুকের তলায় কোথায় একটা বড় যোগ আছে, সেটা বেশ অনুভব করা যাচ্ছিল।
হরিদ্বারে এসে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ একজনের। লোকটা সাধু-সন্ন্যাসী কিনা। জানে না। পরনে ধপধপে সাদা থান, গায়ে সাদা ফতুয়ার ওপর সাদা চাদর। লম্বা দোহারা চেহারা, গায়ের রং ফর্সা নয়, তামাটে। মাথার চুলে কদমছাট। দাড়ি-গোপ কামানো পরিষ্কার হাসি-হাসি মুখ। বছর বত্রিশ-তেত্রিশের মধ্যে বয়েস।