আর এক ব্যাপারে রুচিরা গোড়াতেই সাবধান করে দিয়েছিল। এম. এ. ফাইনাল। পরীক্ষার আগে কোনো ছেলেপুলে নয়। তারও সাফ জবাব, ও তোমার ব্যাপার তুমি ভাববে, সাবধান হতে হয় নিজে হবে–এসব আমার কোষ্ঠীতে লেখা নেই।
গোড়া থেকেই বুকের তলায় ঘা পড়ছিল রুচিরার। কিন্তু এখনো সে ভাবতে চায় না জীবনের সব থেকে বড় ব্যাপারে সব থেকে বড় ভুলটাই সে করে বসেছে। কিন্তু সে-রকম কোনো গণ্ডগোল দানা বেঁধে ওঠার আগেই বাড়ির কর্তা অর্থাৎ রুচিরার শ্বশুর হঠাৎ বেশিরকম অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন আবার এই ছেলের মতিগতি অন্যরকম দেখল। রুচিরার বাবার তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু শ্বশুরের তাতে আপত্তি। ছেলে দুহাতে পয়সা খরচ করে হাসপাতালের সমস্ত সুব্যবস্থা বাড়িতেই করে ফেলল। শাশুড়ী অনেককাল আগেই গত হয়েছিলেন, রুচিরা ভিন্ন বাড়িতে আর দ্বিতীয় মেয়েছেলে নেই। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য দুজন নার্স রাখা হল, আয়া রাখা হল। রোগীর অবস্থা যত ঘোরালো হয়ে উঠছে, ইন্দ্র ব্যানার্জীর মনের অবস্থাও তত খারাপ হচ্ছে। দিন-রাত বাপের কাছে বসে থাকে, কারখানায়ও যায় না। পাগলের মতো সাত বার করে রুচিরার বাবার কাছে ছোটে। বাবাকে সারিয়ে তুলতেই হবে -আর কি করা যায়?
সেদিন তো রুচিরার সামনে ওর বাবাকে ধমকেই উঠল প্রায়, একটুও তো সুবিধের দেখছি না, আরো বড় ডাক্তার কে কোথায় আছে ডাকুন!
এই রোগে রুচিরার বাবাই নামজাদা স্পেশালিস্ট। কিন্তু জামাইয়ের মানসিক অবস্থা দেখে কোনো অভিমান না রেখে ভদ্রলোক আরো দুজন নামকরা ডাক্তার নিয়ে এলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না শেষ পর্যন্ত। ওদের বিয়ের আড়াই মাসের মধ্যে শ্বশুর চোখ বুজলেন।
…এই দাপটের ছেলেকে খুন বাপের বুকের ওপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে দেখেছে। রুচিরা। একেবারে অসহায় বাচ্চা ছেলের মতো কান্না। রুচিরাই তখন সান্ত্বনা দিয়েছে। তাকে। টেনে তুলতে চেষ্টা করেছে। ওই লোক তখন অকারণে রাগ করলে বা বিরক্ত হলেও ওর সহিষ্ণুতায় ফাটল ধরেনি।
কিন্তু মানুষের চরিত্র যাবে কোথায়? আবার দুমাস যেতে-না-যেতে যে-কে সেই। বাবা ঘরে থাকার দরুন ঘরে যেটুকু সংযম ছিল সেটুকুও গেল। আবার খটাখটি বাধতে লাগল। রুচিরা যদি চুপচাপ দেখে যায়, যা বলে প্রতিবাদ না করে শুনে যায়,তাহলে হয়তো কোনো গোল থাকে না।কিন্তু অন্যায় দেখলে বা স্নায়ুতে ঘা খেলে রুচিরাও যুঝতে ছাড়বে না। যা বলার সোজাসুজি বলে দেবে। কিন্তু বাধা পেলেই মানুষটার ভিতরে যেন কি বিষের ক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। অন্যায় বা জুলুম বুঝলেও জোর করেই তা করবে। সব কিছুই তখন যেন একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে যায়। উল্টে শাসায়, কারো বাবার ধার ধারি না, ভাল না লাগে চুপ করে থাক, মাস্টারি করতে এসো না।
রুচিরার ধারণা, ও পছন্দ করে না বলেই বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাড়িতে বসেই এক-এক সন্ধ্যায় মদ গেলে এখন। রাগ করে রুচিরা বাপের বাড়ি চলে এলে দস্তুরমত শাসায়, এ-ধরনের অবাধ্যতা বরদাস্ত করার ধাত নয় তার। সেই মত্ত অবস্থাতেই এক-এক রাতে জোর করে দখল নিতে আসে। নেয়ও। ও কিছুতে আপত্তি করলেই সেটা আরো বেশি করে করার দুরন্ত ঝোঁক চাপে লোকটার। এমন কাণ্ড করে যে রুচিরার মাথা খারাপ হবার দাখিল এক-একসময়।
তার স্তাবকের সংখ্যা আরো অনেক বেড়েছে। আড্ডায় বসে গেলে কারখানা কামাই করে। বলতে গেলে ঝাঝালো জবাব দেয়, আমি কারখানায় যাই বা না যাই তোমার তাতে কি?
অবশ্য রুচিরা যখন বলতে যায় তখনো সেটা একেবারে শ্লেষশূন্য হয় না। এদিকে কোথা থেকে তাড়া তাড়া নোট আসছে, রুচিরা ভেবে পায় না। ওড়াচ্ছে, ফুর্তি করছে। কিছু বলতে গেলেই দাবড়ানি। কিন্তু বলার যা রুচিরাও বলবেই। আরো খারাপ লাগে। যখন সাঙ্গোপাঙ্গর মারফত একে-ওকে হুমকি দিয়ে পাঠায়। রুচিরা বলে, এটা কি মগের মুলুক নাকি?
সে হেসে জবাব দেয়, মগের মুলুক কিনা দেখছ না?
রুচিরার ভিতরটা বিষিয়েই যেতে থাকল। মনের অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সে বছর আর তার এম. এ. পরীক্ষাই দেওয়া হল না। হেসে হেসে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে ছড়াল ইন্দ্র ব্যানার্জী। বলল, ভালই হল, এই বিদ্যের ঝঝেই অস্থির আছি।
মেয়ে কেমন আছে রুচিরার বাবা-মায়ের কাছেও সেটা গোপন থাকল না। একদিন জামাইকে এ নিয়ে দুকথা বলতে এসে বাবা দস্তুরমতো অপমানিত হয়ে ফিরে গেলেন।
গোঁ ধরে রাতে এক-একদিন বাড়িই ফেরে না ইন্দ্র ব্যানার্জী। রুচিরা একদিন কটুক্তিই করে উঠেছিল। জবাবে সে বলেছে, হোটেলের সেই একটা ঘর তো তুমি চেনো, সে-ঘরে তোমার আগেও মেয়ে এসেছে, এখনো আসে–বুঝলে?
শুনে রুচিরা স্তব্ধ। তখন থেকেই পরিত্রাণের রাস্তার কথা ভাবতে লেগেছে কিনা বলা যায় না। এর কিছু দিনের মধ্যে শেষ ঘনাল সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার নিয়ে।
যে-বাড়িতে থাকে তার ভাড়া মাসে ছশো। এখন এ-বাড়ি ছাড়লে ভাড়া তার ডবল হবে। শ্বশুর থাকতে কখনো বাড়িভাড়া বাকি পড়েনি। কিন্তু এখন চার মাসের ভাড়া বাকি। বার কয়েক লোক পাঠিয়ে বয়স্ক বাড়িঅলা নিজে এসেছেন ভাড়ার তদবির করতে।
তাকে দেখেই ইন্দ্র ব্যানার্জী খাপ্পা-লোক পাঠিয়ে উত্যক্ত করছেন, এখন নিজে এসেছেন ভাড়া আদায় করতে, কেমন? যান, দেব না–হিম্মত থাকে কোর্টে গিয়ে ভাড়া আদায় করুন।