ভেবেছি। তোমার কেমিক্যাল কারখানা কি এদিকে নাকি?
হেসে উঠল।আমার কারখানা উল্টোদিকে, এখান থেকে বারো মাইল দূরে সেই যাদবপুর ছাড়িয়ে গড়িয়ার কাছাকাছি।
-তেলের অভাব নেই বোঝা যাচ্ছে।
ইন্দ্র ব্যানার্জী আরো হাসতে লাগল।–এই দিনে আবার তেলের অভাব! একটু তেল দেবার জন্য গৌরী সেনরা সব বসেই আছে।
-বেশ। এ-রকমটা সপ্তাহের মধ্যে কদিন চলবে?
–এ-রকমটা মানে?
–এই বারো মাইল ঠেঙিয়ে, এসে আমার ট্রাম-বাসের ধকল বাঁচানো?
গম্ভীর মুখেই একটু হিসেব করে নিল।-সপ্তাহে দুতিন দিন আমাকে চৌরঙ্গীর দিকে আসতেই হয়।
ছদ্ম গাম্ভীর্যে একটা নিশ্বাস ফেলল রুচিরা। মাত্র!
ইন্দ্র ব্যানার্জী সকৌতুকে ফিরে তাকাল একবার।-বল তো বাকি কদিন কারখানার ড্রাইভারকে দিয়ে জীপ পাঠিয়ে দিতে পারি।
রুচিরা এবারে উৎসুক যেন একটু। ঘুরে তাকাল।–দুতিন দিনই যথেষ্ট, এই দুতিন দিনও শুধু ড্রাইভারকে পাঠানো যায় না?
ইন্দ্র ব্যানার্জী আবার ঘাড় ফেরালো তার দিকে। রুচিরা হেসেই ফেলল।
.
বলতে গেলে বছরের মধ্যে ছমাসই ছুটি কলেজ-য়ুনিভার্সিটিগুলোর। সব মিলিয়ে বাকি ছমাসের মধ্যে সপ্তাহে দুতিন দিন সত্যিই ইন্দ্র ব্যানার্জীর জীপে চেপে সে বাড়ি ফিরেছে। না, বাড়িতে নয়, সামনের ওই মোড় পর্যন্ত। কিন্তু পাড়ার অনেকের সেটা চোখে পড়েছে। য়ুনিভার্সিটির ছেলে-মেয়েরা তো কিছু একটা ধরেই নিয়েছে। কিন্তু সত্যিই এই একটা বছরে ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো দিন কোনো রকম কথা-বার্তা হয়নি। মানুষটা কত যে বেপরোয়া এই একটা বছরে রুচিরা খুব ভাল বুঝে নিয়েছে। এ-রকম লোককে কথায় কৌতুকে বিদ্রপে নাজেহাল করতে পারার মধ্যে বেশ একটা মাদকতা আছে। মেজাজ দেখালে রুচিরা ডবল মেজাজ দেখায়। ইন্দ্র ব্যানার্জী ওর দিকে চেয়ে হাসে। বলে, তোমার অদৃষ্টে দুঃখ আছে।
রুচিরা জবাব দেয়, অদৃষ্টের হাত তোমার ইচ্ছেয় ঘুরবে না কোনোদিন।
কিন্তু এর বেশি কথা কখনো হয়নি।
এরপর সুশীতল চক্রবর্তীর ওই প্রস্তাব, আর রুচিরার প্রত্যাখ্যান এবং অস্বস্তি। সুশীতল যা বুঝে গেছে তার অনেকটাই যে সত্যি, রুচিরা সেটা অনুভব করে। কিন্তু সত্যি তো ইন্দ্র ব্যানার্জীর সঙ্গে এ-নিয়ে কোনো রকম ফয়সলায় আসেনি সে।
দুদিন বাদে তার সঙ্গে দেখা। জীপ একটু ফাঁকায় আসতে রুচিরা জিজ্ঞাসা করল, সুশীতল চক্রবর্তীকে চেনো?
-না। সে আবার কে?
–য়ুনিভার্সিটির নামকরা ছাত্র ছিল আগাগোড়া, এখন কলেজের প্রোফেসর। সম্পর্কে দিদির দেওর। বি. এ. পড়ার দুবছর আমাকে বাড়িতে এসে পড়িয়েছে–
মুখে শুঙ্কার ভাব এনে ইন্দ্র ব্যানার্জী জিজ্ঞাসা করল, বিনে পয়সায়?
-তাছাড়া আবার কি? এখনও পড়াচ্ছে।
–কি সর্বনাশ! তারপর?
পরশুর আগের দিন সে এসে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল।
রুচিরা হঠাৎ সত্যি সত্যি গম্ভীর দেখল ইন্দ্র ব্যানার্জীর মুখ। জীপটা রাস্তার ধারে– থামিয়ে দিতে দেখে আরো অবাক।
ইন্দ্র ব্যানার্জী জীপেই ঘুরে বসল তার দিকে।লোকটার ঠিকানা কি?
–তার ঠিকানা দিয়ে কি হবে?
–ধড় থেকে মাথাটা নামিয়ে নিয়ে আসি।
রুচিরা হঠাৎ যেন ধাক্কাই খেল একটা। মানুষটা সত্যি-সত্যি ক্রুদ্ধ না ইয়র্কি করছে তাই বোঝা গেল না। এবারে সেও ঝাঁঝিয়ে উঠল, ইস, মুরোদ কত, তুমি তার গায়ে আঙুল ছুঁইয়ে দেখ দেখি!
এবারে ঠাণ্ডা হল একটু।–তোমার সায় না থাকলে ছোঁয়াব না। তারপর কি দাঁড়াল?
–কি আবার দাঁড়াবে? মাঝখানে তুমি দাঁড়ালে।
এবারে উৎফুল্ল।–সত্যি?
রুচিরা হাসিমুখে মাথা নাড়ল। সত্যি।
আনন্দে জীপ হাঁকাল আবার। একটু ভেবে নিয়ে রুচিরা বলেই ফেলল, কিন্তু এ-ভাবে আর কতদিন চলতে পারে? তোমার মতলবখানা কি?
–আমার মতলব অনেকদিন ধরেই খারাপ। এম. এ. পরীক্ষার আগে তোমার যদি আপত্তি না থাকে তো ঝুলে পড়ি এসো!
রুচিরা ধমকে উঠল, কথাবার্তার ছিরি কি! বাবাকে তো বলতে হবে।
–আজই চল। বলে ফেলি।
রুচিরা হেসে ফেলল। ভাল লাগছে। এই মানুষকে ভয়ানক ভাল লাগছে আজ তার। এরকম ভাল লাগার স্বাদ এই যেন প্রথম। মাথা নাড়ল, তোমাকে বলতে হবে না, আমি মাকে বলে রাখব, আমাদের বাড়ি থেকে তোমার বাবার কাছে প্রস্তাব গেলে তিনি যেন আকাশ থেকে না পড়েন–তাঁকে বলে রেখো। বুঝেছ?
-খুব বুঝেছি। তোমার আমার ব্যাপারের মধ্যে আবার বাবা-মাদের ধরে টানাটানি। ঠিক আছে
জীপ হাওয়ায় ছুটেছে এখন। এক নামকরা অভিজাত হোটেলের সামনে এসে থামল সেটা। রুচিরাকে নামিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। দিনটা সেলিব্রেট না করে আজ আর বাড়ি ফিরতে দিচ্ছে না তাকে, আগেই বলেছে। রুচিরা হাঁ করে দেখল, এখানকার কায়দা-দুরস্ত মানুষগুলো সব এই লোকের সুপরিচিত। কোট প্যান্ট টাই পরা একজন ছুটে এল। কি কথা হল রুচিরা জানে না। লিফটে করে দোতলায় নিয়ে গিয়ে সে তাদের ছোট্ট ফিটফাট গালচে বিছানো ঘরে এনে ছেড়ে দিল। ঘরে বড় বড় শৌখিন সোফা সেটি পাতা।
লোকটা চলে যেতে রুচিরা জিজ্ঞাসা করল, এখানে কি?
–এখানে খাওয়াদাওয়া আর আনন্দ।
বলেই দরজাটা জোরে ঠেলে দিয়ে মানুষটা আচমকা যে আনন্দে মেতে উঠল তার জন্য রুচিরা একটুও প্রস্তুত ছিল না।
ওর হাড়-পাজরগুলোও যেন খসে খসে পড়বে! ওই বুকের সঙ্গে ওর বুক পিষে ফেলার আগে যেন ছাড়বে না। এমন চুমু খেয়ে চলেছে যে দম বন্ধ হওয়ার দাখিল। গোটা দেহটা অবশ করে ফেলছে। তারপর পিঠের ওপর অকরুণ দুটো হাতও যেন অবাধ্য হয়ে উঠছে।