গাড়ি আরো একখানা বাবা ইচ্ছে করলে কিনতে পারেন বটে, কিন্তু এম. এ. পড়ার জন্য ড্রাইভার সমেত আরো একটা গাড়ি রাখার কথা ভাবতেও রুচিরার লজ্জা।
এই ভাবেই চলেছিল গোড়ার মাস দুই। তারপর হঠাৎ ব্যতিক্রম একদিন। ছুটির পর মিনিবাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। ঘ্যাঁচ করে পাশেই একটা জীপ এসে থামল। তার পরেই চক্ষুস্থির রুচিরার। সেই জীপে শুধু ড্রাইভার বসে। এবং সে স্বয়ং ইন্দ্র ব্যানার্জী। রুচিরা তাকে না দেখতেই চেষ্টা করল। তাড়াতাড়ি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু জীপ থামিয়ে যে দাঁড়িয়ে গেছে সে এটুকু দেখেই চলে যাবার লোক নয়। জীপের ওই বিতিকিচ্ছিরি হর্নটা টিপে ধরে বসে রইল। আর একটানা সেই শব্দে বাসের জন্য আর যারা অপেক্ষা করছিল, চকিত হয়ে তারা ওদের দুজনকেই দেখতে লাগল।
বিপাকে পড়ে রুচিরাকে আবার ওই জীপের দিকেই ঘুরে দাঁড়াতে হল। আর একগাল হেসে তক্ষুণি ওই বেহায়া বেশ চেঁচিয়েই অতিপরিচিতের মতো বলে উঠল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়াশুনার ধ্যান হচ্ছে নাকি? উঠে এস
ঠিক যেমনটি হলে রুচিরার মাথায়ও ঝোঁক চেপে যায়, এও যেন তেমনি। পরিস্থিতি একটি। কোনোদিকে না চেয়ে সোজা জীপে উঠে এল। পাশের সীটে বসল। তারপর গাড়ি তিরিশ গজ এগোতেই ঝাঝাল গলায় জিজ্ঞাসা করল, এ-রকম অসভ্যতার মানে কি?
সামনের দিকে চোখ রেখে হাসিমুখে নির্লিপ্ত গলায় ইন্দ্র ব্যানার্জী ফিরে জিজ্ঞাসা করল, দেখেও না-দেখার ভান করে অন্য দিকে ঘাড় ফিরিয়ে থাকার মানে কি?
-মানে আমার দেখার ইচ্ছে নেই।
–আমারও অসভ্যতার মানে জোর করে দেখানোর ইচ্ছে।
আরো রাগত স্বরে রুচিরা বলল, আমি জীপে না উঠলে কি করতে পারতে?
–না উঠতে পারলে তুমি উঠতে না। আমার ইচ্ছে বাতিল করা খুব সহজ ব্যাপার নয়।
–তাহলে গাড়ি থামাও, আমি নেমে যেতে পারি কিনা দেখো!
থামানোর বদলে হাসতে হাসতে গাড়ির বেগ আরো বাড়িয়ে দিল ইন্দ্র ব্যানার্জী। তারপর আলতো করে বলল, এত রাগের কারণ কি, ট্রামে-বাসে চাপাচাপি করে যেতে খুব ভাল লাগত?
–হ্যাঁ, লাগত। তোমার তাতে কি? সত্যি সত্যি এত রাগ কেন হচ্ছে রুচিরা জানে না।
-হিংসে, স্রেফ হিংসে।…তা বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলে, গাড়ি কি হল? রুচিরা এবার চেষ্টা করল ঠাণ্ডা হতে। ও যত রেগে যাচ্ছে, লোকটার যেন তত মজা। জবাব দিল, গাড়ি ঠিকই আছে, কারো হিংসে হলেই এখানে চার বার করে গাড়ি যাতায়াত করবে না।
-তার মানে রোজ ট্রাম-বাসে যাতায়াত?
–আসি গাড়িতে, যাই মিনিবাসে।
–তার মানে তো আবার একদফা এসপ্লানেডে চেঞ্জ!
–তাতে কার কি?
হাসছে আবার বলল, এই যুগটাই অন্যরকম। কত ধকল বাঁচালাম, উপকার করলাম–তার বদলে পাচ্ছি রাগ। অবশ্য এও আমার ভালই লাগছে।
– আবারও রাগের অনুভূতিটা ঠেলে তরল করল রুচিরা। ঠাণ্ডা মুখে জিজ্ঞাসা করল, ধকল বাঁচানো আর উপকার করার জন্য জীপ নিয়ে ঘুরে বেড়াও?
হাসছে।–কাজ না থাকলে তাও বেড়াই। ধকল বাঁচানো আর উপকার করার। মতো মেয়ে দেখলে তুলেও নিই।
কানের ভিতরটা রি-রি করে উঠল রুচিরার।–আমাকে তুলে নেবার মতো মেয়ে ভেবেছ?
সামনে চলন্ত গাড়ির ভিড়। তার ফাঁকেই মুখ ঘুরিয়ে ওকে একবার ভাল করে দেখে নিল। হেসে উঠল হা-হা করে। জবাব দিল, তুলে নিলাম কিনা দেখলে না?
রুচিরা গুম হয়ে বসে রইল। মনে মনে নিজেরই মুন্ডপাত করতে লাগল সে। কেন সে জীপে উঠতে গেল! এবারে কিছুটা আন্তরিক সুরে ইন্দ্র ব্যানার্জী বলল, সত্যি অনেক দিন তোমাকে না দেখে মেজাজটা এত খারাপ হয়ে গেছল! আজ ভাগ্যিস ঠিক এই সময়ে এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম!
এ-কথা শোনার পর রুচিরার কেন যেন আগের মতো রাগ হল না। দোষ এই লোকেরই। হঠাৎ হঠাৎ মগজের মধ্যে ওলট-পালট কাণ্ড বাধিয়ে দেয়। ইচ্ছে থাকলেও ঠাণ্ডা মাথায় এখন দুটো ভাল কথা বলার উপায় নেই।
এসপ্লানেড ছাড়িয়ে জীপ মাঠের মাঝের ফাঁকা রাস্তা ধরে ছুটল। স্পীড কম করে ষাট মাইল হবে। রুচিরা আড়চোখে দেখছে এক-একবার। লোকটার যেন ধৈর্য বলে কিছু নেই, সবেতে হুড়মাড় ব্যাপার।
বাড়ির সামনের মোড়টার কাছে আসার আগেই রুচিরা বলল, এখানে থামতে হবে।
-কেন?
–আমি নামব।
–কেন?
–কেন আবার কি, আমার খুশি!
কেন এখানে নামতে চায় ইন্দ্র ব্যানার্জীর না-বোঝার কথা না। বাড়ির লোকেরা আর পাড়ার লোকের চোখ এড়াতে চায়। আপত্তি না করে জীপ থামাল। রুচিরা নেমেই হন হন করে সামনে এগোলো। পিছনে বসে লোকটা যে হাসছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পরদিনও য়ুনিভার্সিটির শেষ ক্লাস সারা হবার আগে রুচিরার কেমন মনে হল ইন্দ্র ব্যানার্জী আজও জীপ নিয়ে আসবে। প্রোফেসারের লেকচার শোনা হয়ে গেল। আর কিছু কানে ঢুকছে না। ঘণ্টা বাজতে রুচিরা বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবছিল, তাকে ফাঁকি দেবার জন্য উল্টো দিকের কোনো ট্রামে বা বাসে উঠে পড়বে কি না। কিন্তু ভিতর থেকে সায় মিলল না। তাতে কোথায় যেন নিজেরই লোকসান। আসে। যদি, আর কিছু না হোক বাসে ওঠা আর বাস বদলানোর ধকলটা তো বাঁচে।
য়ুনিভার্সিটির গেটের বাইরে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিচিত হর্ন। রুচিরা বিষম চমকে ঘুরে তাকাল। আজ একেবারে য়ুনিভার্সিটির ফুটপাথ ঘেঁষেই জীপ নিয়ে অপেক্ষা করছে। হাসছে।
রুচিরা থমকে দাঁড়াল একটু। চোখে চোখ। হঠাৎ হাসি পেয়ে যাচ্ছিল তারও। কিন্তু হাসল না। এমন মুখ করে জীপে গিয়ে উঠে বসল যেন ওরই জীপে ড্রাইভার গোছের কেউ অপেক্ষা করছে। ভিড়ের মধ্য দিয়ে সুপটু হাতে চালাতে চালাতে হৃষ্টমুখে ইন্দ্র ব্যানার্জী বলল, আজও আসব, ভাবনি তো?