এ জবাব শুনে রুচিরার মেজাজ আরো গরম হল বই ঠাণ্ডা হল না। বলে উঠল,, আমি তোমার কোনো খবরই রাখি না–বুঝলে? ড্রাইভার!
ড্রাইভারটা কি ভেবে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়েছিল কে জানে। ডাক শুনে তাড়াতাড়ি চাবি ঘুরিয়ে সেলফ টানল।
কিন্তু ইন্দ্র ব্যানার্জী হাসছে। আর তক্ষুনি জানলা ছেড়ে সরে দাঁড়াল না। বলল, মেয়েদের এমন খামোখা রাগের কি যে অর্থ কে জানে! আমি আরো খুশী হয়ে এলাম অভিনন্দন জানাতে! যাক, আমার সম্পর্কে খবর রাখে না এ তল্লাটে এমন কেউ আছে জানা ছিল না।…খবর এরপর আমিই দিতে চেষ্টা করব তাহলে।
গাড়ি ছেড়ে সরে দাঁড়াতে ড্রাইভারটাই যেন হাঁপ ফেলে বাঁচল। গাড়ি ছাড়ার পর রুচিরার মেজাজ ঠাণ্ডা হতে বেশি সময় লাগেনি। সত্যি তার রাগ করার কোনো মানে হয় না। পাড়ার মধ্যে নামজাদা মানুষ একটা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওই শুরুতেই তুমি শুনে মেজাজটা বিগড়ে গেছল। জবাবে সেও ছেড়ে কথা বলেনি—তুমি’ই বলেছে। এত হিম্মত এ-তল্লাটের কোনো মেয়ের হত বলে মনে হয় না। যেতে যেতে সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা অজানা রসের মতো পেতে লাগল রুচিরা। …এমন ডাকসাইটে মাতব্বর মানুষ, ওর পাসের খবরটা ঠিক রেখেছে। আবার রুচিরার রাগের জবাবে চান্স পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের এম. এস-সি পাস করার খবর জানিয়ে দিয়েছে। রুচিরা এটা সত্যিই আশা করেনি। এম. এস-সি পাস জেনে এখন যেন একটু ভালই লাগছে। বিদ্বানের দুরন্তপনা একটু অন্য ব্যাপার। সেটা মস্তানির পর্যায়ে পড়ে না। তাছাড়া চাকরি-বাকরির মধ্যে না ঢুকে নিজে কেমিক্যাল কারখানা করেছে এটাও পুরুষোচিত কাজ মনে হয়েছে। গোলামি করা রুচিরা দুচক্ষে দেখতে পারে না। তাছাড়া ওই লোক কোথাও চাকরি করতে গেলে রক্তারক্তি করে বেরুনোও বিচিত্র নয়।
মরুকগে। রুচিরা. এ-সব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে কেন? মাথায় ব্যাপারটা তবু ঘুরপাক খেতেই থাকল।…কায়দা করে কারখানার আধখানা মালিকানার কথাও জানিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু এর মধ্যে একটা কথা ঠিকই কানে লেগে আছে রুচিরার। ও গাড়ি চেপে এই গেট ছাড়িয়ে কলেজের দিকে চলে গেলেই ওই লোক নাকে-মুখে ভাত গুঁজে কারখানায় ছোটে। তার মানে, বাড়ির গেটের কাছে ও-সময় তার দাঁড়িয়ে থাকাটা শুধু ওরই জন্যে। কথাবার্তার মধ্যেও কোথাও যদি ছিটেফোঁটা রাখা-ঢাকার ব্যাপার থাকত! নির্লজ্জ আবার কাকে বলে!…এর পর থেকে নিজেই নিজের খবর দেবে বলে দিল। রুচিরার অস্বস্তি। এ-লোক মুখে যা বলে কাজেও অনায়াসে তাই করতে পারে। কি করবে? রোজ রাস্তায় এভাবে গাড়ি আটকাবে, না, বাড়ি এসে হাজির হবে? রুচিরার ভাবনাই ধরে গেল।
সে য়ুনিভার্সিটিতে ঢোকার মুখে এই লোককে নিয়ে ঝামেলার মোড় ঘুরল আর এক ভাবে। ঝামেলা ছাড়া আর কি বলবে রুচিরা? না, গাড়ি আর একদিনও থামায়নি। আর রুচিরার সময়ের হিসেব পায় না বলে রোজ আর গেটেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না তাকে। এম. এ. ক্লাসের রুটিন আর কলেজের রুটিনে তফাত আছে। কোনোদিন এগারোটায় ক্লাস, কোনোদিন বারোটায়, কোনোদিন একটায়। এই রুটিনের কল্যাণেই এদিক থেকে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে। এদিকে য়ুনিভার্সিটিতে ঢোকার পর রুচিরার যাতায়াতের ব্যবস্থাও কিছু বদলাতে হয়েছে। বিকালের দিকে বাবা বড়জোর এক ঘণ্টা সোয়া ঘন্টার জন্য গাড়ি ছেড়ে দিতে পারেন। আগে কাছেই কলেজ ছিল, ড্রাইভার এক ফাঁকে গিয়ে তাকে নিয়ে আসত। তাই যাতায়াত দুটোই বাড়ির গাড়িতে চলত। এখন শুধু যাওয়াটা গাড়িতে হয়। আসাটা ট্রামে বা বাসে। কিন্তু রুচিরা এ পর্যন্ত ট্রাম বা এমনি বাসে উঠতেই পারে না। ওই গাদাগাদি ভিড় দেখলেই তার মাথা ঘোরে। দুই একদিন চেষ্টা করে উঠেছিল। কিন্তু ভিড়ের চাপে দম বন্ধ হওয়ার দাখিল। মেয়ে দেখলে অসভ্য লোকগুলোর চাপাচাপি যেন আরো বাড়ে। সবাই যে অভব্য তাই বলে তা নয়, বেশির ভাগই সভ্য। কিন্তু এমন যাচ্ছেতাই ভিড় হলে লোকে করবেই বা কি।
অতএব ওকে আসতে হয় বেশি পয়সা খরচ করে মিনিবাসে। কিন্তু ওই সময়ে। মিনিবাসও বেশির ভাগ বোঝাই হয়ে আসে। পর পর কয়েকটা ছাড়লে একটাতে যদি জায়গা মেলে। তাও না হয় হল, কিন্তু কোনো মিনিবাসই তো উত্তর থেকে টানা দক্ষিণ কলকাতায় আসে না। এসপ্লানেডে এসে সেই মিনিবাসও আবার চেঞ্জ করতে হয়। আর এটাই সব থেকে অসহ্য ব্যাপার। এক ঘণ্টা দাঁড়িয়েও একটা মিনিবাস ধরতে পারে না এমনও হয়। ফলে রোজই বাড়ি ফিরতে রুচিরার সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়, যার ফলে বাড়ি ফেরার পর থেকে মেজাজটা খিঁচড়েই থাকে। সমস্যাটা মাকে বলেছে। মা বলেছে বাবাকে। বাবা ধকলটা অস্বীকার করেন না, কিন্তু মুখে বলেন, দশজনে। যা করছে তাই একটু-আধটু করতে পারার অভ্যাস থাকা ভাল–তা না হলে রুচির জন্যে তো আবার একটা গাড়ি কিনতে হয়।
আবার একটা মানে দাদার জন্য একটা ছোট গাড়ি আছে এবং সেটা বাবার টাকাতেই কেনা। দাদাও ডাক্তার। কিন্তু তার গাড়ি চাওয়া আর তার একখানা হাত বা পা চেয়ে বসা যেন একই ব্যাপার। দাদার পসার বাবার ষোল আনার এক আনাও না। কিন্তু সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার গাড়ি চরকির মতো কলকাতার রাস্তা চষে বেড়াচ্ছে। গাড়ি পেতে হলে বউদিকেই দস্তুরমতো ঝগড়াঝাটি করে আদায় করতে হয়। তাছাড়া দাদার গাড়ি পেলেই বা কি? চালাবে কে? দাদা তার নিজের গাড়ির নিজেই ড্রাইভার।