এবারে বাবা বিরক্ত একটু।–এত রাতে আমি কোথাও যাই না–কোথায় যেতে। হবে?
-পার্ক সার্কাসের দিকে। আমার এক বন্ধু কিছুদিন ধরে ভুগছিল, টাকা-পয়সার অভাবে ভাল ডাক্তার দেখাতে পারেনি। খবর পেয়ে তাকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি অজ্ঞান হয়ে আছে। চার টাকা ফী-এর এক ডাক্তার দেখছিল, সে কিছু বুঝতে পারছে বলেই মনে হল না। আপনি দয়া করে চলুন আমার সঙ্গে, আমি নিজে আবার আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব
বিরক্তি চেপে বাবা বললেন, কিন্তু এত রাতে আবার আমি পার্ক সার্কাস যাব-ওদিককার কাউকে পেলে না?
লোকটার জবাব দস্তুর মত উদ্ধত ঠেকল রুচিরার কানে। সে বলছে, আর দেরি করবেন না, আমি আপনাকেই নিয়ে যাবার জন্য এসেছি, আমি সঙ্গে থাকছি, আপনার কোনো ভয় নেই। আর রাতও খুব একটা বেশি হয়নি।
বাবা তার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন একটু। তারপর বললেন, আচ্ছা, তুমি গাড়িতে গিয়ে বসো, আমি ব্যাগটা নিয়ে আসছি–
ইন্দ্র ব্যানার্জী ও-দিকের দরজা দিয়ে বেরুলো, বাবা এদিকে ফিরলেন। দরজার কাছে রুচিরাকে দেখে বললেন, ব্যাগটা এনে দে–
মেয়ের দ্বিধা দেখেই তিনি বুঝলেন সে না বুঝেই তাকে ওপর থেকে ডেকে এনেছে। গলা খাটো করে বললেন, ঘাবড়াবার কিছু নেই, ব্যাগটা নিয়ে আয়–না গেলে বরং ঝামেলার ব্যাপার হতে পারে, দিন-কাল ভাল নয়।
রুচিরা তক্ষুণি ওপরে এসে বাবার ডাক্তারি ব্যাগটা এনে দিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার ওই লোকটার ওপর। বাবাকে প্রায় শাসিয়েই এই রাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মনে হতে লাগল তার।
এক ঘণ্টার মধ্যেই বাবা বাড়ি ফিরলেন। রুচিরা দোতলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। নিজেই জীপ ড্রাইভ করে বাবাকে বাড়ির দরজায় নামিয়ে দিয়ে গেল।
কিন্তু দোতলায় উঠতে রুচিরা দেখল বাবার এখন প্রসন্ন মুখ। তার হাত থেকে ব্যাগটা নিতে নিতে রুচিরা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। বাবা বললেন, না রে, ছেলেটার অন্তঃকরণ আছে। গিয়ে দেখি ওর সেই বন্ধু বলতে গেলে এক বস্তি-ঘরের ছেলে। তাকে ঘিরে বিধবা মা আর বোন-টোনগুলো কান্নাকাটি করছে।…হার্ট অ্যাটাক, বেঁচে যেতে পারে হয়তো, কিন্তু ঝামেলা আছে। আমাকে নিয়ে ফেরার আগে ওই বিধবা মায়ের হাতে ব্যানার্জীর ছেলেটা তিনশো টাকা গুঁজে দিয়ে এল দেখলাম, বলল, কান্নাকাটি রেখে এখন ভাল শুশ্রূষার দিকে মন দিন, কিছু ভাবনা নেই, ভাল চিকিৎসাও হবে, সেরেও যাবে।
রুচিরা তবু ফোঁস করেই বলে উঠল, আর তোমার ফী?
বাবা হাসলেন। বললেন, দূর পাগলি, এই দেখেও হাত পেতে আমি ফী নিতে পারি নাকি! চৌষট্টি টাকা ফী দেবার জন্যেই ঝোলাঝুলি করছিল, আমি ধমকে উঠতে আর কিছু বলেনি।
শুনল যা তাতে কারো রাগ হবার কথা নয়। শুনে ওরও ভাল খুবই লেগেছে। কিন্তু ওই দাপট দেখিয়ে বাবাকে টেনে বার করে নিয়ে গেছল যে সেটা কিছুতে ভোলা যাচ্ছিল না।
পরদিন গেটের সামনে ইন্দ্র ব্যানার্জীকে দেখা গেল না। মন বলল, তার সেই অসুস্থ গরীব বন্ধুকেই দেখতে গেছে।
সন্ধ্যের দিকে জীপ হাঁকিয়ে তাকে বাবার চেম্বারে আসতে দেখেছে পর পর কয়েকদিন। আবার একদিন দিনের বেলায় এসে বাবাকে নিয়েও গেছে। রুচিরা সব দোতলা থেকেই লক্ষ্য করেছে। একদিনও নীচে নেমে আসেনি। কিন্তু এখন আর রাগ নেই। ভিতরে ভিতরে উল্টে কেন যেন খুশীই একটু। বন্ধুর কঠিন অসুখে বাবা সাহায্য করছেন বলে কি আর কোনো কারণে, বলা শক্ত।
.
দুজনের সম্পর্কটা বেশ একটু সরস নাটকের দিকে গড়ালো রুচিরার বি. এ. পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুনোর পর। গাড়ি চেপে সেদিন বিকেলের দিকে, দিদির বাড়ি যাচ্ছিল, ওই মূর্তি তখন তার বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে। গাড়িতে ওকে আসতে দেখেই গেট ছেড়ে রাস্তায় এসে একটা হাত তুলে ড্রাইভারকে গাড়িটা থামাতে হুকুম করল। আর হিন্দুস্থানী ড্রাইভারটাও কিছু না বুঝে গাড়িটা থামিয়ে নিল।
মিষ্টি মিষ্টি হেসে পিছনের খোলা কাঁচ নামানো জানলায় দু-হাতে ঠেস দিয়ে বলল, কংগ্রাচুলেশনস!
রুচিরা হাসছে না। গম্ভীর।–কেন?
–শুনলাম বি. এ. পরীক্ষায় তুমি সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়েছ
তুমি! শোনার সঙ্গে সঙ্গে হাড়-পিত্তি যেন একসঙ্গে জ্বলে উঠল রুচিরার। আর সঙ্গে সঙ্গে কাণ্ডজ্ঞানও প্রায় খুইয়ে বসল। বলে উঠল, থ্যাংক ইউ। তা তোমার নিজের পড়াশুনার দৌড় কদ্দূর?
এই ঝাপটা খেয়েই ইন্দ্র ব্যানার্জী যেন, সত্যিকারের খুশীতে আটখানা একেবারে। তার যেন কান-মন জুড়িয়ে গেল। এ-যাবৎ মেয়েদের ও স্তব-স্তুতি দেখে অভ্যস্ত। এই এক মেয়ে তার ব্যতিক্রম বটে।
বলল, নিশ্চয় সেটা তোমার জানার অধিকার আছে। তিন বছর আগের কলকাতা য়ুনিভার্সিটির গেজেট খুলে দেখো–কোনরকমে এম. এস-সি-টা পাস করেছিলাম!
এ-খবর অপ্রত্যাশিত বটে। সোজা মুখের দিকে আবার তাকাল রুচিরা, মিথ্যে বলল বলে মনে হল না। কিন্তু এ-ভারে জানলায় ঠেস দিয়ে গাড়ি থামিয়ে রাখাটাই বা বরদাস্ত করে কি করে? তাছাড়া আবারও তুমি বলল, আর বলল, জানার তোমার অধিকার আছে। রুচিরার তার ওপর অধিকার ফলাবার কি দায় পড়েছে?
তেমনি ঝাঝালো সুরেই আবার বলে উঠল, তবে আর কি, এতবড় পণ্ডিত হবার, পর রাতদিন এখন লোকের ওপর মাতব্বরি করে বেড়ানো ছাড়া আর কি কাজ থাকতে। পারে!
-সে কি কথা! উৎফুল্ল অথচ আহত যেন।-আমার ওপর এই বিচার তোমার,! তুমি কলেজে চলে যাবার পরেই নাকে-মুখে ভাত গুঁজে আমাকে ছুটতে হয় কারখানায়, আমি এখন একখানা কেমিক্যাল ফার্মের অর্ধেক মালিক সে-খবর রাখো?