…সর্বগ্রাসী বন্যার খবর পেয়ে কলকাতা থেকে কংগ্রেসের এক তরুণ দল সরকারী সাহায্যের ব্যবস্থা নিয়ে জলপাইগুড়ি চলে গেছল। সেই তরুণ দলের নায়ক ইন্দ্র ব্যানার্জী। সেখানে গিয়ে নায়কের মতই একটি কাজ করেছে। নিজের প্রাণের মায়া। তুচ্ছ করে জলমগ্ন কুটিরের এক বুড়ীকে উদ্ধার করে এনেছে। কাগজে যা লিখেছে তা সত্যি হলে ওই ছেলেও যে মস্ত এক ফাড়া কাটিয়ে উঠেছে, সন্দেহ নেই। বুড়ীকে আগলে পুরো ছত্তিরশটি ঘণ্টা অনাহার আর অনিদ্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি বসে থাকতে হয়েছিল তাকে।
দিন-কতক বাদে আবার তাকে গেটের সামনে দেখতে পেল রুচিরা। আগের দিনই তার আসার খবর কানে এসেছিল। খুব ঘটা করে মালাটালা পরিয়ে পাড়ার ছেলেরা নাকি তাকে স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছে।
গাড়িটা ও-বাড়ির গেট পার হওয়ার সময় এই একটি দিন আবার রুচিরা তাকে যেন দেখতেই পেল না। ইচ্ছে করে রাস্তার উল্টো দিকে মুখ করে বসে রইল। ভেবেছে, অত বাহাদুরির খবর পড়ে রুচিরাও আনন্দে গলে গিয়ে বীরপুরুষকে নতুন চোখে দেখবে। কিন্তু কাগজের ছবি দেখে আর খবর পড়ে রুচিরাও যে দুঃসাহসের প্রশংসা মনে মনে করেনি, এমন নয়।
পরের দিনের ব্যাপারটা অন্যরকম। রুচিরার প্রথমে রাগ যেমন হয়েছে, পরে মজাও তেমনি লেগেছে। ওর কলেজ যাবার সময় ইন্দ্র ব্যানার্জী সেদিনও গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল। সঙ্গে দুজন স্তাবকও ছিল। ও ছেলের সঙ্গী-সাথীদের স্তাবক ছাড়া আর কিছু ভাবে না। দূর থেকে ওদের দেখে এই দিনও রুচিরা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে ছিল।
হঠাৎ গাড়িটা প্রায় থেমেই যেতে ঈষৎ বিস্ময়ে ড্রাইভারের দিকে তাকাতে গিয়ে। রুচিরার সামনের দিকে চোখ পড়ল। রাস্তার ঠিক মাঝখানে গাড়ির পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে ইন্দ্র ব্যানার্জী। গাড়িটা প্রায় থামিয়ে ড্রাইভারও সবিস্ময়ে তাকিয়েছে সেদিকে।
রুচিরার সঙ্গে চোখাচোখি হতে ধীর গম্ভীর মুখে রাস্তা ছেড়ে আবার নিজের বাড়ির গেটের দিকে চলল। রুচিরা ঘাড় ফিরিয়ে দেখে সেখানে অন্য ছেলে দুটো ওর দিকে চেয়েই হাসছে ফিক ফিক করে।
রুচিরা সেদিন জ্বলতে জ্বলতে কলেজে চলল। হিন্দুস্থানী ড্রাইভারটা পর্যন্ত কি ভাবল কে জানে! কিন্তু জ্বলুনি থাকল না বেশিক্ষণ। তার ওপর মজার প্রলেপ পড়তে লাগল।
এর পরদিন থেকে কলেজ যাবার সময় আবার চোখ দুটোকে ওবাড়ির গেটের দিকে ফেরাতে হল তাকে। তা না হলে পরদিনই আবার রাস্তা আগলে দাঁড়াবে কিনা কে জানে। লোকটার ঠোঁটের ফাঁকে জ্বালা-ধরানো হাসি। তাকে অবজ্ঞা করলে কি হবে সেটাই যেন বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। রুচিরার এ জুলুম বরদাস্ত করার ইচ্ছে নেই। কিন্তু রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলে ও করবে কি? আর টের পেয়ে গেলে লোকেই বা ভাববে কি? এর থেকে একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকানো স্বস্তির ব্যাপার।
আরো কিছুদিন পরের কথা। রাত তখন সাড়ে নটা। পড়াশুনার পাট শেষ করে রুচিরা খাবার টেবিলের দিকে যাচ্ছিল। দাদা তার উদ্দেশ্যে একটা হাঁক দিয়ে বসে গেছে। রাতে দাদা-বউদির সঙ্গে খায়। দিনের বেলা যে-যার সময় মত খেয়ে নেয়। রাতে বাবার খাওয়া একটু দুধ, একটা সন্দেশ, আর খই। তার খাবারটা মা এর অনেক আগেই ঘরে দিয়ে আসেন।
বাধা পড়ল। পুরনো চাকর মহেশ এসে বলল, একটি বাবু নীচে ডাকছেন।
রাত সাড়ে নটায় নীচে বাবু ডাকছেন শুনে রুচিরা হাঁ। ছেলেদের মধ্যে এ বাড়িতে একমাত্র আসে সুশীতল। তাকে খবর দিয়ে আসতে হয় না। সরাসরি আসে।
-কে বাবু?
–ইন্দরবাবু।
রুচিরা হতচকিত কয়েক মুহূর্ত। কি করবে বা কি বলবে ভেবে পেল না। তারপর। মায়ের চোখের আড়াল হয়ে চুপচাপ নীচে নেমে এল। রাত সাড়ে নটায় বাড়ি এসে চাকর দিয়ে তাকে খবর দেওয়া যে চলবে না এটা প্রথম দিনেই তাকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।
বৈঠকখানার দরজা খোলা। ইন্দ্র ব্যানার্জী সেখানে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের ছবি দেখছে। মুখ গম্ভীর, একটু ক্লান্তও যেন।
রুচিরা এসে দাঁড়াতেই কোনো ভূমিকা না করে বলল, আমি ডক্টর গাঙ্গুলীর কাছে এসেছিলাম, কিন্তু এখানকার লোকটা বলল, ডাক্তারবাবুকে এখন আর খবর দেওয়া চলবে না, তাই একটু বিরক্ত করতে হল। ডক্টর গাঙ্গুলীকে একবার খবর দিতে হবে, বিশেষ দরকার।
চোখ-মুখ দেখে রুচিরার মনে হল কারো বাড়াবাড়ি গোছের ব্যাপার কিছু। প্রথমেই তার বাবার কথা মনে হল।
-বসুন, আমি খবর দিচ্ছি।
দৌড়ে ওপরে চলে এল। ডাক্তারের বাড়ি, এ-সব ব্যাপারে ঘড়ির নিয়ম মানা চলে না। বাবা তখন আধ-শোয়া হয়ে একটা ডাক্তারি জার্নাল পড়ছেন। বলল, ইন্দ্র ব্যানার্জীর বাবার বোধহয় বাড়াবাড়ি অসুখ কিছু হবে, সে নীচে তোমাকে ডাকছে, বলল খুব দরকার
শুনে রুচিরার বাবা একেবারে তৈরি হয়ে তাড়াতাড়িই নেমে এলেন। পিছনে রুচিরাও না এসে পারল না। কিন্তু তারপর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে যে-কথা শুনল, তার দু-চক্ষু স্থির। শোনার পর লোকটার ওপর যত রাগ, বাবাকে না বুঝে-শুনে এভাবে ডেকে আনল বলে তেমনি সংকোচ।
বাবা ঘরে ঢুকতেই দুহাত তুলে নমস্কার জানিয়ে ইন্দ্র ব্যানার্জী বলল, আপনাকে এখনই একবার আমার সঙ্গে এক জায়গায় একটু যেতে হবে।
এ-কথা শুনে বাবা অবাক।–কি ব্যাপার?
–চলুন। সঙ্গে গাড়ি আছে। গাড়িতে বসে বলছি।