জয়ন্ত রঙ্গ খুব মিথ্যে ঠাট্টা করেনি। সুলক্ষণাকে নিয়ে ওর সঙ্গে বেশ একটা রেষারেষি ছিল আমার। বলত, মনে ধরলেই বা ইউ. পি-র মেয়েকে নিয়ে বাঙালীবাবুর কি আশা! সুলক্ষণার সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দেখলে সামনে চোখ পিটপিট করত, আড়ালে বিচ্ছিরি করে হাসত। রাজনীতির আলোচনায় গলা চড়ালেই টিপ্পনী। কাটত, ঝুমরি তো কাছেই বসে আছে, অত চেঁচিয়ে গলার শিরা ফোলানোর কি দরকার? ঝুমরির অনুপস্থিতিতে চুপ মেরে গেলেও জয়ন্ত হুল ফোঁটাতে ছাড়ত না। বলত, মেঘ দেখলে তবে ময়ুর নাচে। শ্ৰীমতী কাছে না থাকলে বাঙালীবাবুর। জিভ নড়ে না। কৃষ্ণকুমারকে চুপিচুপি একবার সতর্কও করে দিতে চেষ্টা করেছিল। শুনেছি। ঝুমরির ব্যাপারে আমার হাবভাব নাকি ভাল নয়। কৃষ্ণকুমার কানে তোলেনি। ঝুমরিকেই বলে দিয়েছিল। সে-কথা শুনে ঝুমরির কি রাগ। আমাকেই বলেছিল, ফাঁক পেলেই ও আমাকে কি জ্বালান জ্বালায় তোমরা তার খবর রাখো? কৃষ্ণদাকে বলি না বলে–
বললে খুশি হতাম। আমার হাবভাব যা-ই হোক তাতে কোনোরকম নোংরামি ছিল না। তবু এ-কথা ঠিক, আচমকা অতবড় একটা অঘটন ঘটে না গেলে ওই মেয়েকে নিয়ে নিজের বাড়ির লোকের সঙ্গে বড় রকমের কোনো বিদ্রোহের সূচনা হত কিনা বলা যায় না। ঝুমরিকে নিয়ে আমি সম্ভব অসম্ভব অনেক রকমের কল্পনার জালে জড়িয়ে পড়ছিলাম।
কৃষ্ণকুমারের ভবিষ্যৎবাণী ঠিক হয়নি। ঝুমরির ভালো বিয়ে হওয়া দূরে থাক, এ-ভাবে যে ও নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনতে পারে কেউ কল্পনাও করেনি। বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতোই বিমূঢ় হয়ে গেছলাম আমরা। ও বাড়ির লোকেরাও। এ আশ্রয় ছেড়ে, বিশেষ করে কৃষ্ণকুমারের মায়া ছেড়ে হঠাৎ এক রাতে ও নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে–এমন অবিশ্বাস্য কাণ্ড কে ভাবতে পারে? কৃষ্ণকুমারের অবস্থা তখন ভাল নয়। কাল ব্যাধি। গলা দিয়ে প্রায়ই রক্ত ওঠে। ঝুমরির তার জন্য দুশ্চিন্তার। অন্ত ছিল না। কৃষ্ণকুমারের বাবা ছিলেন গোঁড়া কবিরাজ। নাম যশও ছিল। গোঁ ধরে ছেলের কবিরাজি চিকিৎসাই চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মতে আয়ুর্বেদের ওপর আর কোনো চিকিৎসা নেই। কৃষ্ণকুমারও তাই মেনে নিয়েছিল কিনা জানি না। নিজের চিকিৎসা নিয়ে বাপের ওপর কখনো কথা বলেনি। কিন্তু আমরা বলতাম। ঘর ছাড়ার দিন কতক আগেও ঝুমরি আমাদের ওপরেই ফুঁসে উঠেছিল, কৃষ্ণদাকে তোমরা এখান থেকে নিয়ে চলে যেতে পারো না? অন্য চিকিৎসা করাতে পারো না? কৃষ্ণদা মরতে চলেছে দেখেও বুঝতে পারছ না?
বুঝতে পেরেও আমরা কিছুই করিনি বা করতে পারিনি। কিন্তু ঝুমরি এ কি করল? তার কৃষ্ণদাকে পর্যন্ত এত বড় আঘাত দিয়ে চলে গেল! শোনার পরেও ও সত্যি কারো সঙ্গে স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে চলে গেছে এ কিছুতে বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না। ক্ষেপে গিয়ে কৃষ্ণকুমারের বাবা বার বার বলেছে, রক্তের দোষ। রক্তের দোষ যাবে কোথায়! বাপ যেমন মেয়ে তেমন। কৃষ্ণকুমারের মা বেচারীর লজ্জায় আর অপমানে মাথা নীচু। রক্তের দোষ বললে তারও লাগার কথা। নিজের ভাইয়ের মেয়ে, রক্তের যোগ তার সঙ্গেও আছে। ঝুমরির খোঁজে আমার ছোটাছুটি আর হয়রানি দেখে কৃষ্ণকুমারও শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়েই বলেছে, কোথাও পাবে না, যেখানেই যাক ও নিজের ইচ্ছেতেই গেছে। শুনে আমি দমে গেছি, কিন্তু বিশ্বাস হয়নি। ঝুমরির মধ্যে কোনো মন্দের ছিটেফোঁটাও আছে ভাবতে পারতাম না। হাসি-খুশি বুদ্ধিমতী মেয়েটা প্রয়োজনে তীক্ষ্ণ হতে পারে, কঠিন হতে পারে, সেটা বুঝতে পারতাম। বাপের কারণে হোক বা যে-কারণেই হোক ওর ভিতরটা যে খুব সুস্থির নয় তাও অনুভব করতে পারতাম। কিন্তু তা বলে ঝুমরির এমন মতি হবে, কৃষ্ণকুমার বললেও মন সেটা মেনে নিতে চায়নি। উল্টে বরং মনে হয়েছে বিপাকে পড়ে ঝুমরি হয়তো আমাকেই সব থেকে বেশি স্মরণ করছে। আমি আছি বলেই হয়ত তার উদ্ধারের প্রত্যাশা।
ফলে কৃষ্ণকুমার যা বলেছে সেটা আমাকে বিচলিত করলেও মনের সায় মেলেনি। সন্দেহটা প্রথমে যার ওপর ঘোরালো হয়ে উঠেছিল সে এই জয়ন্ত রঙ্গ। ও যে রসিকতা করল তা অবশ্য করিনি। গলায় হাত দিইনি। তবে তার দিক থেকে গলদ কিছু থাকলে গলা যে কাটা যাবেই হাবভাবে সেটা ওকে ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। বড়লোকের ছেলে। চটুল মতি। মুখের কথা খসালে ঝুমরির জন্য অনেক খরচ করত। প্রায়ই সিনেমা দেখাতে চাইত, রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে চাইত। ঝুমরি ওকে একেবারে যে বাতিল করত তা নয়, কিন্তু আড়ালে বলত, পাজির পা-ঝাড়া একটা। কিন্তু আমি যদি কখনো বলি, ওকে প্রশ্রয় দাও কেনঝুমরি ফোঁস করে উঠেছে, বেশ করি, তোমার গায়ে জ্বালা ধরে কেন?
ঝুমরির চোখের আগুন আর ঠোঁটের হাসির এই রীতি। আর আমার চোখে এও তার রূপ। ও নিখোঁজ হবার পর জয়ন্তকে ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনেক জেরা করেছি। আর আড্ডা দেবার ছলে কম করে পনের দিন কড়া নজরে রেখেছি ওকে। ওকে সঙ্গে করেই ঝুমরির খোঁজে এলাহাবাদ চষেছি।
জয়ন্ত রঙ্গকে বাতিল করার পর আর একটা বাজে লোককেও সন্দেহ হয়েছিল আমার। তার নাম মধু যাদব। বিহারের লোক। জীবিকার তাগিদে কেমন করে কৃষ্ণকুমারদের বাড়ি এসে জুটেছিল জানা নেই। ঝুমরি আসারও বছর দুই আগে থেকে ও-বাড়িতে ছিল সে। বয়সে আমাদের থেকে বছর তিনেক বড় হতে পারে। খাওয়া থাকা ছাড়া কৃষ্ণকুমারের বাবা সেই দিনে মাসে চল্লিশ টাকা মাইনে দিত ওকে। ফলে ঠিক চাকরের পর্যায়ে পড়ে না লোকটা। তবে বাড়ির লোক ফরমাশ করলে মুখ বুজে চাকরের কাজও করত। আর ঝুমরি বললে তো কথাই নেই। মুখের কথা খসালে গন্ধমাদন বয়ে নিয়ে আসবে। আড়ালে আবডালে আমরা ঠাট্টা করতাম সীতা দেবীর হনুমানের মতোই সুলক্ষণার ভক্ত হনুমান মধু যাদব। শুনে ঝুমরিও হাসত খুব। কখনো বলত, দাঁড়াও বলছি ওকে।