সুমিতা বলছিল আর হাসছিল খুব। রুচিরা অবাক, তোকে কে বলল?
বলেছে সুমিতার সেই পিসতুতো ভাই-যে এখন ওই ইন্দ্রদার অন্ধ ভক্ত।
তার দলের ছেলেরা নাকি নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, ডাক্তারের ছোট মেয়েটার বড় দেমাক, ঝকঝকে গাড়ি চেপে কলেজে যায়, কলেজ থেকে ফেরে– কোনো দিকে তাকায় না। কত যেন রূপসী, যেন তাকালে ছেলেরা হাঁ করে ওকে গেলার জন্য বসে আছে।
তাই শুনে ইন্দ্র ব্যানার্জী নাকি বলেছে, মেয়েটার চোখ দুটো কি সুন্দর লক্ষ্য করে দেখেছিস তোরা? খবরদার ওর পিছনে লাগবি না!
ছেলেরা নাকি তাদের মুকুটমণি ইন্দ্রদার ওই কথায় মুখ-চাওয়াচাওয়ি করে চুপ মেরে গেছে।
শুনে রুচিরার কেন যেন হঠাৎ রাগ হয়ে গেছে, আবার ভিতরে ভিতরে একটু খুশীও হয়েছে। রাগ ছেলেগুলোর কথা শুনে হতে পারে, আবার ইন্দ্র ব্যানার্জীর মুরুব্বিয়ানার কথা শুনেও হতে পারে। ওর পিছনে লাগার সাহস যেন কারো আছে! আর খুশীর কারণ হয়তো বা ছেলেটার দেখার মতো নিজের দুটো চোখা আছে ভেবে। হতে পারে।
কিন্তু ইন্দ্র ব্যানার্জীর সমস্ত চেহারার মধ্যে যে বেশ একটা জোরালো পুরুষের ছাপ আছে এটা রুচিরা নিজের মনেও অস্বীকার করতে পারে না। গায়ের রং মোটামুটি ফর্সা, দস্তুরমতো লম্বা। বুদ্ধিমাখা চাউনি, জোড়া ভুরু। মুখে মিষ্টি মিষ্টি হাসি, কিন্তু ইচ্ছে করলেই চোয়াল দুটো যেন কঠিন হতে পারে। না মোটা না রোগা। মাথার ঝাকড়া চুলে চিরুনির বদলে হাত চালায় বেশি। ওদের বাড়ির পাশ দিয়েই গাড়ি চেপে সে কলেজে যায় আর কলেজ থেকে ফেরে। যাবার সময় প্রায়ই নিজের বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সাগরেদদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখে। ভিতরে একটু কৌতূহল ছিল। বলেই হয়তো বাড়ির সামনে চোখ ফিরিয়ে বড় একটা তাকায় না রুচিরা। যেটুকু দেখার দূর থেকেই দেখে নেয়। কলেজ থেকে ফেরার সময় গেটটা ফাঁকাই দেখে। তখন বড় একটা চোখে পড়ে না।
সুমিতার মুখে এ-খবরটা শোনার পর রুচিরার কেমন মনে হয়েছে, কলেজে যাবার সময় প্রায়ই যে ওই ছেলেকে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কারো না কারো সঙ্গে কথা বলতে দেখে, তার পিছনে ব্যাপার কিছু থাকতেও পারে। ঘরে বসে আড্ডা দেয় না কেন? সুমিতা চলে যেতে সেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের এই দুটো চোখের দিকেই অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল রুচিরা। তারপর নিজেই লজ্জা পেয়েছে। জ্ব কুঁচকে আয়নার সামনে থেকে সরে এসেছে। কিন্তু একটু খুশীর ছোঁয়া যে মনে লেগেছিল সেটা অস্বীকার করতে পারে না। সুমিতার কাছ থেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটা কথা জেনে নিতে পারলে মন্দ হত না। বীরপুরুষটি লেখাপড়া করছে কিনা, বা কদ্দূর করেছে। নাকি বিদ্যাদিগগজ হয়ে মস্তানি করে বেড়াচ্ছে? আবার ভেবেছে, একেবারে শূন্যকুম্ভ হলে পাড়ার অল্পবয়সী এম. এল. এ. দুজন হামেশাই ও-বাড়ি আসে কেন? বাপের সঙ্গে হোমরা-চোমরাদের খুব দহরম-মহরম হলেও ওই দুজনের তার ছেলের সঙ্গেই খাতির বেশি। তারা লেখাপড়া জানা ছেলে শুনেছে। তাদের বন্ধুর পেটে একেবারেই কিছু থাকবে না? তাছাড়া বেপরোয়া হলেও হাব-ভাব আচরণ শিক্ষিত ছেলের মতই।
খেয়াল হতে রুচিরা নিজেকেই চোখ রাঙিয়েছে আবার। লেখাপড়া জানা থোক বা ক অক্ষর গোমাংস হোক, ওর অত ভাবার দরকার কি?
দরকার থাক বা না থাক, পরদিন কলেজ যাবার সময় চেষ্টা করেও চোখ দুটো। অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনি। অথচ গাড়িতে ওঠার সময় বার বার নিজের মনে সংকল্প করেছে, কক্ষনো কোনো দিকে তাকাবে না। কিন্তু পরিচিত গেটটা পার হবার আগেই চোখ দুটো ঠিক ওই দিকেই ঘুরেছে।
আর যোগাযোগ এমনি যে, এই দিনে গেটের সামনে একলাই দাঁড়িয়ে সে। সঙ্গী সাথী নেই। রুচিরা ঘাড় ফেরানো মাত্র চোখাচোখি। ওই গেট পার হবার আগেই। আর সঙ্গে সঙ্গে রুচিরার নিজের ওপর রাগ যেমন, ভিতরের গোঁ-ও তেমনি। চেয়ে রইল তো চেয়েই রইল।
সেই ছেলেও।
গেট ছাড়িয়ে গাড়িটা এগিয়ে গেল। রুচিরার তখন নিজের ওপরেই এমনি রাগ যে ইচ্ছে করছিল গাড়িতেই ঘুরে বসে পিছনের কাঁচের ভিতর দিয়ে সেই দিকে চেয়েই থাকে। কারণ চোখাচোখি হতে ইন্দ্র ব্যানার্জীর ঠোঁটের ফাঁকে হাসি দেখেছে। যেন বলতে চেয়েছে এতদিনে সদয় হলে যা হোক
কিন্তু এরপর এই চোখাচোখি হওয়ার ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটতে লাগল। রুচিরার ঠোঁটের ফাঁকে কখনো হাসির ছোঁয়া লাগে, কখনো বা ভুরুর মাঝে ছদ্ম বিরক্তির ভাঁজ পড়ে। কথা নেই বার্তা নেই, এ যেন এক মজার খেলা।
দিন-কতক বাদে পর পর কয়েক দিন ওই গেটের সামনে ইন্দ্র ব্যানার্জীকে দেখা গেল না। অসুখ-বিসুখ কিছু করেছে এমন নয়। দুদিন আগে ওর বাবা রুচিরার বাবার কাছে এসে ব্লাডপ্রেসার চেক করিয়ে গেছেন। ওপর থেকে তার গাড়ি দেখে রুচিরা বাবার চেম্বারের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছিল। বাবাকে ধরে নিয়ে গেলে বোঝা যেত। কারো কিছু অসুখবিসুখ করেছে। তা যখন নয় ঘরে ঢুকে তো আর জিজ্ঞাসা করতে পারে না, আপনার গুণধর ছেলের খবর কি?
অপ্রত্যাশিত খবরটা হঠাৎ কাগজে দেখা গেল। কয়েক দিন ধরেই কাগজে জলপাইগুড়িতে ভয়াল বন্যার খবর বেরুচ্ছিল। কাগজের এ-সব খবর রুচিরা দেখেও দেখে না। কিন্তু সেদিন আর না দেখে বা ঘটনাটার আদ্যোপান্ত না পড়ে পারা গেল না। গোড়াতেই ইন্দ্র ব্যানার্জীর ছবি একখানা। তারপর তার দুঃসাহসের প্রশংসার ফিরিস্তি।