— সুশীতল চলে যাবার পর ওর কান্নাই পাচ্ছিল। কেন এ-রকম হল? কেন এ-রকম হয়? সুশীতল খুব–খুব ভাল এটা সে অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু স্বামী হিসেবে তাকে ভাবা যায় না কেন? ও এমন কি মেয়ে? পুরুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে এমন রূপের সম্বল কিছুই নেই। গায়ের রং ঠিক ফর্সা বলা চলে, স্বাস্থ্য মোটামুটি, নাক-মুখ পটে আঁকা নয়। কেবল, ওপরতলার কিছু প্রসাদ আছে ওর চোখ দুটোতে। যে দেখে সে-ই সুন্দর বলে। লুকিয়ে চুরিয়ে রুচিরাও আয়নায় নিজের এই চোখ দুটোকে কম দেখে না। ওর আর যা-কিছু রূপ তার সবটাই বুকের তলায়। কারো কষ্ট দেখলে দুঃখ হয়, কারও আনন্দ দেখলে খুশী হয়। কারো উদারতা দেখলে ভিতরটা ভরে যায়, নিপীড়ন দেখলে নিজের ভিতরেই যন্ত্রণা হতে থাকে। কত সময় ভাবে, সকলেই একটু উদার হলে, একটু দরদী হলে, একটু নিঃস্বার্থ হলে, এই পৃথিবীটা তো কত সুন্দর হতে পারে।…হয় না কেন?
চোখ দুটো ছাড়া ওর ভিতরের এই রূপের খোঁজ পেতে হলে স্বাদ পেতে হলে যে অবকাশ দরকার আর অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য দরকার, একমাত্র সুশীতল চক্রবর্তীই সেটা পেয়েছিল। কিন্তু তাকে তো সে সরাসরি বাতিল করে দিল। অথচ তার জন্যও যে কত দুঃখ হচ্ছে রুচিরা সেটা কাকে বলবে?
সুশীতল চলে যাবার পরদিনই দিদি এসেছিল, গম্ভীর। হাব-ভাবে বুঝিয়েই দিল বোনের ওপর রাগ হয়েছে। বহুক্ষণের মধ্যে ওর সঙ্গে কোনো কথাই বলল না। ফলে রুচিরার রাগ দ্বিগুণ। ও ভাল কথায় জল, মেজাজ দেখালে আগুন। মনে মনে ভাবল, দিদির চেহারা-পত্র ওর থেকে একটু ভাল, সেই দেমাকে ভাবে ওর দেওরের থেকে ভাল বর আর পাব কোথায়।
রুচিরাও সেধে একটি কথাও বলতে এল না।
যাবার আগে দিদি ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞাসা করল, কাকে সব সমর্পণ করে বসে আছিস?
–তোর বরকে! হল?
যা-ই হোক, বোনকে দিদি ভালই বাসে। হেসে ফেলল।-থাপ্পড় খাবি। কে এমন। লোক এল যে শীতলকে একেবারে বাতিল করে দিলি–শুনিই না?
রুচিরার মেজাজ তখনো ঠাণ্ডা হয়নি। চটপট জবাব দিল, বিনয়দার থেকে ভাল এটুকু জেনে রাখ–জানলে তোর হিংসে হতে পারে।
রাগ দেখিয়ে চলে গেল। না গিয়ে করবে কি? দিদির জেরার মুখে পড়লে কি বলবে? কার নাম করবে?
কিন্তু রুচিরা আর যা-ই হোক, মেয়েটা বোকা নয় একটুও। ওরই দিকে চেয়ে একজন বেপরোয়া মানুষ যে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে এটা সে অনুভব করতে পারে। তার নাম ইন্দ্র ব্যানার্জী। এই অভিজাত দক্ষিণ এলাকায় তাকে চেনে না এমন কেউ নেই। রুচিরা অন্তত ছেলেবেলা থেকেই চিনত। কলেজে পড়তেই পাড়ার সমবয়সী ছেলেদের মাতব্বর হয়ে বসেছিল। সেই খুনোখুনির রাজনীতির সময় তার সম্পর্কে গা-কাটা দেবার মত অনেক গাল-গল্প কানে এসেছে। মোট কথা, সেই দুর্যোগের সময় এই এলাকা একেবারে ঠাণ্ডা ছিল শুধু তার দাপটে। একবার মাত্র এই পাড়ার ওপর হামলার সূচনা হয়েছিল। সুযোগ পেয়ে বাইশ বছরের একটা ছেলেকে কারা ছোরা। আর রিভলভার দেখিয়ে জীপে তুলে নিয়ে পালাচ্ছিল। বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে। ঘটনাটা তক্ষুণি পাড়াময় রটে গেছল। সেই বিধবা বুক চাপড়ে রাস্তায় বেরিয়ে অজ্ঞান। হয়ে গেছল। পাড়ার ছেলেরা তাকে ধরাধরি করে রুচিরাদের বাড়ি নিয়ে এসেছিল। রুচিরার বাবা তার চিকিৎসা করেছিলেন। শুধু এ-এলাকার কেন, কলকাতার মধ্যেই। একজন নামী ডাক্তার রুচিরার বাবা।
কিন্তু দুঘণ্টার মধ্যেই পাড়ায় আবার হৈ-চৈ। বিধবার সেই ছেলে অক্ষত অবস্থায় আবার ঘরে ফিরে এসেছে। পরদিন কাগজে খবর বেরিয়েছে, হত্যার উদ্দেশ্যে অমুক জায়গার একটি ছেলেকে কারা জীপে তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল। কোথা থেকে আরো দুটো জিপ হঠাৎ এসে তাদের ওপর চড়াও হয়। অতর্কিতে আক্রান্ত হবার ফলে দুষ্কৃতকারীদের তিনজন গুরুতর আহত হয়, আর বাকি দুজন হত্যার বলি সেই ছেলেটাকে ফেলে পালিয়ে যায়। ছেলেটা নিরাপদে ঘরে ফিরেছে। কিন্তু কে বা কারা তাকে উদ্ধার করেছে জানা যায়নি, কারণ তারাও পুলিস আসার আগে নিজেদের জীপ নিয়ে সরে পড়েছে। ছেলেটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কিছু জানা যায়নি। মনে হয় এটা কোনো রাজনৈতিক দলাদলির ফল। আহতদের অবস্থা আশংকাজনক।
ওই বিধবার ছেলেটা যে রুচিরার বন্ধু সুমিতার পিসতুতো ভাই জানা ছিল না। সে চুপি চুপি রুচিরাকে বলেছিল, এত বুকের পাটা কার জানিস না? ইন্দ্রদার।-খবর কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দুটো জীপ নিয়ে আর দল নিয়ে ওদের ঘাঁটিতে গিয়ে। হানা দিয়েছিল।
শুনে রুচিরা কণ্টকিত।–পুলিস জানে না?
–জানলেই বা কি। ইন্দ্রদার বাবা কংগ্রেসের কত বড় চাই জানিস না?
তা অবশ্য জানে। অনেক এম. এল. এ. ছেড়ে কংগ্রেসী মন্ত্রীরাও কত সময়। ইন্দ্র ব্যানার্জীদের বাড়ি আসে।
ইন্দ্র ব্যানার্জীর বাবা হাই ব্লাডপ্রেসারের রোগী। রুচিরার বাবার পেশেন্ট। বাবা বুদ্ধিমান মানুষ, তার কাছ থেকে ফী নিতেন না। বাবার খবর দেবার জন্য ইন্দ্র ব্যানার্জী কখনো-সখনো তাদের বাড়ি আসত। তখন কখনো কখনো রুচিরার সঙ্গে চোখের দেখা হত শুধু, মনের ব্যাপারের ধারে-কাছেও কেউ নেই। কিন্তু রুচিরার ভিতরে ভিতরে এই বেপরোয়া ছেলেটার প্রতি কৌতূহল ছিল।
রুচিরা যখন বি. এ. পড়ে, তখন সেই বন্ধু সুমিতার কাছেই হঠাৎ একদিন শুনল, ওদের ইন্দ্রদা নাকি রুচিরার চোখ দুটোর খুব প্রশংসা করছিল।