বি. এ. পরীক্ষার সময় সপ্তাহে কম করে চার পাঁচদিন তাকে পড়াতে আসত। সুশীতল। এম.এ-তে ঢোকার গোড়া থেকেই সেই রকমই আসতে লাগল। মুখে। কোনো দিন এতটুকু আভাস ব্যক্ত না করলেও তারপর থেকে কেন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করছিল রুচিরা। জল হোক ঝড় হোক সে ঠিক আসবে। এসে যে কোনো রকম বাজে কথায়. সময় কাটাত তা নয়। তখন আবার কলেজের নতুন মাস্টার সুশীতল। উৎসাহ বা উদ্দীপনার অভাব নেই। গোড়া থেকেই নিয়ম করে পড়াশোনার তাগিদও দিত। কিন্তু ইদানীং ওর এম. এ-তে ভাল রেজাল্টই লক্ষ্য লোকটার, ভাবা যাচ্ছিল না। যা ভাবছিল, সেই গোছের ব্যাপার অনেক সময় চোখে-মুখে লেখা হয়ে যায়। রুচিরার ধারণা, সে সেটা নির্ভুল পড়ে নিতে পারছিল। একদিন তাই সরাসরি বলে ফেলেছিল, গোড়া থেকেই এত লেখাপড়া। আমার পোষাবে না বাপু, এ বছরটা অন্তত আগের মত সপ্তাহে দুদিনের বেশি পড়ছি না, পরীক্ষা এলে তারপর দেখা যাবে। বেশি পড়লে মাথা ঝিম ঝিম করে।
পুরু লেন্সের ওধারের চোখ দুটো তার মুখের ওপর থমকেছিল একটু।–মাত্র দুদিন?
-হ্যাঁ। দুদিন তোমার কাছে পড়ব, দুদিন আবার গানে লেগে যাব ভাবছি, আর দুদিন নিজে পড়ব–এমনিতেই তো দিদি কথা শোনায় আমার বি. এ-র রেজাল্টের পিছনে সবটাই তোমার বাহাদুরি।
মুখের দিকে তেমনি চেয়ে ছিল সুশীতল। যদি ফিরে জিজ্ঞাসা করত বাহাদুরিটা সে অস্বীকার করে কিনা, রুচিরা তেমন যুৎসই জবাব কিছু দিয়ে উঠতে পারত না। কিন্তু সে-রকম দাবি জাহির করার মানুষ সুশীতল চক্রবর্তী নয়। তাছাড়া সেকেন্ড ক্লাস ফাস্ট হওয়াটা তার কাছে কোনো ভাল রেজাল্টই না।
কথামতো সপ্তাহে দুদিন করেই আসছিল এর পর। কিন্তু মুখে যাই বলুক, একটু ভাল রেজাল্ট করার তাগিদ রুচিরার ভিতরে ভিতরে ছিলই। আর সেটা যে সবটাই, সুশীতল চক্রবর্তীর ওপর নির্ভর, তাও স্বীকার না করে উপায় নেই। ফাইনাল ইয়ারে পা দিয়েই সুশীতলের আসাটা দুদিনের জায়গায় এবার তিন দিন করে দেবে কিনা, আপনা থেকেই ভাবছিল।
এরই মধ্যে যা ভাবেনি, এক সন্ধ্যায় তাই হয়ে গেল। পড়ানোর মতো মুখ করেই সুশীতল বলল, অনেকদিন ধরে একটা কথা তোমাকে বলি-বলি করে বলা হচ্ছিল না। বউদিকে, মানে তোমার দিদিকে বলেছিলাম, উনি আবার আমাকেই ঠেলে দিলেন। কথা আর কিছু নয়, তোমার বাবা মা-কে এবারে যদি আমি একটা বিয়ের প্রস্তাব দিই, তোমার তাতে আপত্তি হবে কি না।
এমন মুখ করে বলল, যেন বাজারের আলু-পটল কেনার মতো সাদামাটা প্রস্তাব একটা। কিন্তু তাই শুনেই রুচিরা বিষম চমকে উঠল। অতর্কিতে আক্রান্ত হবার মতো মুখ।–বাবা-মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব …ইয়ে, মানে আমাকে বিয়ে?
পুরু লেন্সের ওধারের দুচোখে হাসির ছোঁয়া লাগল।তা না হলে আর তোমার আপত্তি হবে কিনা জিগেস করব কেন?
ভিতরে ভিতরে হাঁসাস দশা রুচিরার।–আমি, মানে, আমি কখনো কিছু এ নিয়ে ভাবিইনি-
–ভাবতে অসুবিধে হচ্ছে?
এমন সঙ্কটে রুচিরা বোধহয় জীবনে আর পড়েনি। ভিতরে ভিতরে নিদির ওপরেই আচ্ছা রাগ হতে থাকল। দিদির মারফত প্রস্তাবটা এলে যা বলার বলে দেওয়া সহজ হত, অন্তত চক্ষুলজ্জার বালাই থাকত না। এবারে জবাব দিতে সময় নিল একটু। তারপর যতটা সম্ভব নরম করে বলল, দেখ, তুমি খুব ভাল, আর তোমাকে আমার ভালও লাগে–কিন্তু এ-রকম চিন্তা আমার কখনো মাথায় আসেনি বা সেভাবে তোমাকে কক্ষনো দেখিনি
রুচিরার দেখার ভুল নয়। চোখের হাসি মিলিয়ে গেছে। না, এই জবাব আশা করেনি। উল্টে বোধহয় ধরেই নিয়েছিল রুচিরার চোখেমুখে সম্মতির খুশীর ছটা দেখবে। তার দিকেই চেয়ে আছে তখনো। বিস্ময়-আশাহত চাউনি। না বুঝে-শুনে দিদি একে কতখানি আশা দিয়ে বসেছিল কে জানে।
বিড়ম্বনা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা মানুষটার। গলার স্বরও এবারে ঠাণ্ডা একটু।–সে ভাবে দেখেছ এমন কেউ এসে গেছে?
প্রাণের দায়ে এবারে সোজাসুজি মাথা নাড়ল রুচিরা। অর্থাৎ তাই। এসে গেছে। খুব সত্যি নয়। আবার একেবারে যে মিথ্যে তাও নয়। ইন্দ্র ব্যানার্জী তখন পর্যন্ত ওর মনের দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়েনি। তবু এর কাছে স্পষ্ট মনোভাবটাই প্রকাশ করল রুচিরা। এসেই গেছে। একেবারে কেউ না এলেও এই মিথ্যের আশ্রয় নিত কিনা জানে না।
সুশীতল চক্রবর্তীর মুখে আবার বিস্ময়ের আঁচড় পড়ছিল।–তোমার দিদিরও এটা জানা নেই নিশ্চয়?
মরীয়া হয়েই জবাব দিল রুচিরা–দিদি কেন, এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। প্লীজ, তুমিও আর দয়া করে জানতে চেও না।
সত্যিই ঠাণ্ডা আর ভদ্র এই মানুষটা। এ নিয়ে আর একটি কথাও বলেনি। আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। খানিকটা আত্মস্থ হয়ে উল্টে বলেছিল, কিছু মনে করো না…আমার জানা থাকলে তোমাকে এভাবে অপ্রস্তুত করতাম না।
রুচিরা সাগ্রহে বলেছে, আমি কিছু মনে করিনি, তুমি কিছু মনে করলে না তো?
–না।…আজ কি পড়বে?
–আজ থাক।
টেবিলের বই দুটো একবার নাড়াচাড়া করে আবার রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। –চলি তাহলে?
কেন যেন ভয়ানক বিচ্ছিরি লাগছিল রুচিরার। তেমনি অস্বস্তি। বলেই ফেলল, পড়াশুনার ব্যাপারে আর তোমার সাহায্য পাওয়ার আশা করাটা ঠিক হবে না বোধহয়?
-কেন?
–আসবে?
–তুমি না চাইলে আসব না।
ভাবের আবেগে রুচিরা বলেছিল, শীতল, তুমি সত্যি অনেক বড়। আমি কিছু না।