সেই দুটো হাত পুরুষের। শক্ত সবল পুরুষ তাকে বলবে না রুচিরা। গোড়ায়। সেই রকমই বুঝেছিল। সেই রকমই ভেবেছিল। স্বয়ং ইন্দ্রের মতোই মাথা উঁচু মনে হয়েছিল ইন্দ্র ব্যানার্জীর। তার দর্প দেখে তার দম্ভ দেখে তখন শুধু পুরুষকারের ছটাই বড় হয়ে উঠেছিল রুচিরার চোখে। তার সঙ্গে বিয়ের যখন সব ঠিক তখনো সেই লোকের ছোটখাটো দুই-একটা অপরাধের নজির সামনে এনে বিয়ে বরবাদ করতে চেয়েহে কেউ কেউ। বাবা-মা শুনে চিন্তায় পড়েছিলেন। দাদা-বউদি দিদি-জামাইবাবু থমকে ছিল।
চাঁদে কলঙ্ক নেই, গোলাপে কাটা নেই–এ কি হয়? কোকিল কালো নয়–এ কি হয়? সোনায় কিছু খাদ না মিশলে তা দিয়ে গয়না হয়? ইন্দ্র ব্যানার্জীর চরিত্রের যেটুকু আভাস পেয়ে বাড়ির সকলে ধাক্কা খেয়েছিল, রুচিরার চোখে পুরুষ প্রবৃত্তির একটা বেপরোয়া দিক মাত্র সেটা। লোকটার মধ্যে লুকোচুরির ব্যাপার নেই, পায়ে কোনো ভয়ের বেড়ি নেই। থাকলে সব-কিছু একটা ম্যাড়মেড়ে ব্যাপার হয়ে যেত। তাহলে সুশীতল চক্রবর্তীর সঙ্গে তার কোনো তফাত থাকত না। হায়ার সেকেন্ডারি থেকে এম. এ. পর্যন্ত নামকরা ভাল ছাত্র সুশীতল চক্রবর্তী। বি. এ-তে ফিলসফিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। এম, এ-তেও তাই। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভাল ছেলে। পান-সিগারেট পর্যন্ত খায় না। চোখে পুরু চশমা। তার ও-ধারের একটু ছোট চোখ দুটো বুদ্ধিতে চিকচিক করে। জোর-জুলুম কাকে বলে জানে না। মিষ্টি মিষ্টি হাসে। সকলে ভেবেছিল, এত ভাল ছেলে আই. এ. এস-এ বসবে। আর বসলে যে পাঁচজনের একজন হবে জানা কথাই।
কিন্তু বসল না। কারণটা রুচিরাকেই কেবল বলেছিল সুশীতল চক্রবর্তী। চোখের যা পাওয়ার তাতে বাতিল হয়ে যাবার সম্ভাবনা ষোলআনা। এই দোষ চাপা দিতে হলে অনেক কারচুপির দরকার। তার মধ্যে সে নেই। তাছাড়া ও-সব লাইন ভালও লাগে না। দু-দুটো ভাল কলেজ থেকে অফার এসেছে। কলেজের মাইনে-পত্র আজকাল খারাপ নয় খুব। একটা নিয়ে নেবে। আরো পড়াশুনা করার ইচ্ছে। সুযোগ হলে ডক্টরেট করে নিয়ে কিছু বই-পত্র লেখার ইচ্ছে।
এই লোক রুচিরার জীবনে সেধে এগিয়ে আসতে চেয়েছিল। বিনয়দার নিজের ছোট মাসতুতো ভাই সুশীতল চক্রবর্তী। বিনয়দা হল দিদির বর। বিলেত-ফেরত এঞ্জিনীয়ার। এক প্রাইভেট এঞ্জিনীয়ারিং ফার্মে মস্ত চাকরি করে বিনয়দা। স্বামীকে নিয়ে দিদির ভিতরে ভিতরে বেশ গর্ব আছে। এই বিনয়দার সুবাদে সুশীতল চক্রবর্তীর এ-বাড়িতে অল্প-স্বল্প আসা-যাওয়া ছিল। রুচিরার থেকে তিন ক্লাস ওপরে পড়ত।
এই বিদ্বান মাসতুতো ভাইটিকে বিনয়দা ভালবাসে খুব। আর দিদি তার থেকেও বেশি। দিদি বয়সে বোধহয় ওর থেকে বছর দেড়েকের বড় হবে। কিন্তু কাছে পেলে রসিকতার ছলে দিদি একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো আদর করত ওকে। একবার তো রুচিরা আর বিনয়দার সামনেই কি কারণে খুশী হয়ে দিদি আচমকা ওর দু-গালে দুটো চুমু খেয়ে বসেছিল। সুশীতল চক্রবর্তীর মুখখানা দেখতে তখন হেসে গড়াবার মতই হয়েছিল।
রুচিরা যখন হায়ার সেকেন্ডারিতে মোটামুটি ভাল রেজাল্ট করে ফিলসফি অনার্সে তিন বছরের কোর্সে বি. এ. পড়তে ঢুকল, সুশীতল চক্রবর্তী তখন এম. এ. ফাস্ট ইয়ার। দর্শনশাস্ত্রের সেতু ধরে তার পর থেকে দুজনের মধ্যে দর্শনের ব্যাপারটা আরো অনেক সহজ আর স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। রুচিরার যেবার বি. এ. পার্ট টু ফাইনাল পরীক্ষা, তার আগের বছর এম. এ. পরীক্ষা দিয়ে সুশীতল চক্রবর্তী সোনার মুখ করে যুনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে। আর সেই অবকাশের অনেকখানি রুচিরাকে সাহায্য করার ব্যাপারে ঢেলে দিয়েছে। মাত্র চারটি নম্বরের জন্য বি. এ-তে ফাস্ট ক্লাস না পেয়ে সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল রুচিরা। এও তার কাছে এমন কি বাড়ির সকলের কাছেও আশাতীত। ফার্স্ট ক্লাস না পাওয়ার খেদ শুধু ওই সুশীতলের।
বেজায় খুশী হয়ে দিদি বলেছিল, এবারে পায়ে হাত দিয়ে তোর মাস্টারকে প্রণাম কর একটা, আর প্রার্থনা কর এম. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পাস।
আজকালকার কলেজে-পড়া ছেলে-মেয়েদের রীতি অনুযায়ী সুশীতলকে নাম ধরে অর্থাৎ বাড়ির সকলের মত শীতল বলেই ডাকত রুচিরা। দিদি এই জন্যেও কম মন্দ বলত না ওকে। শুনলেই চোখ পাকিয়ে ধমক লাগাত।এই! বড় না তোর থেকে?
দিদি এমন কিছু সেকেলে মেয়ে নয়, মাত্র সাড়ে চার পাঁচ বছরের বড় রুচিরার থেকে। তার সময়েও কলেজের সমবয়সী বা একটু আধটু বয়েসের ফারাকের ছেলেমেয়েদের নাম ধরে ডাকাডাকির রীতি ছিল। কিন্তু নিজের আদরের ওই মাসতুতো দেওরটির বেলায় দিদির গোঁড়ামি।
প্রণাম করার হুকুম শুনে বেশ মজার কাণ্ডই করেছিল রুচিরা। চট করে গম্ভীর হয়ে ভারী গলায় ডেকে বসেছিল, শীতল এদিকে আয়
না, একেবারে আধুনিকাদের মতো তুই কখনো বলেনি। তুমি করে বলত। এই ডাক শুনে তো দিদির চক্ষু কপালে। সে ভাবল হয়তো মাঝের এই তিন বছরে বোনের এই উন্নতি। সুশীতল কিন্তু মিটিমিটি হাসছিল। জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন?
–দিদি বলল, শুনলি না? আয় প্রণাম করি
সুশীতল তার পরেও ভালমানুষের মতো এগিয়ে আসতে ধাক্কা মেরে তাকে দিদির। গায়ের ওপর ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। প্রণাম সত্যি করবে দিদি আশা করেনি, কিন্তু ওই তুই-তোকারি শুনে রেগেই গেছল। দিদির মনের তলায় তখনো কি আশা রুচিরা বুঝতে পারেনি।