এর পর আমার প্রথম কাজ কিশোর শেঠকে ছিবড়ের মতো বাতিল করা। আমার আশা ছেড়ে তাকেও একদিন জ্বলতে জ্বলতে ঘরে ফিরতে হয়েছে। আমার ব্যাঙ্কের জমা টাকা বাড়ছেই, অলঙ্কারের ঐশ্বর্যও বাড়ছেই। পুরনো হয়ে যাবার ভয়ে খুব বেশিদিন কাউকে আমি এক নাগাড়ে ধরে রাখি না। ফলে নতুন নতুন মানুষের ধর্ণা দেওয়া আর মাথা খোঁড়ারও বিরাম নেই।
এবারে নিশ্চয় ঘৃণায় শিউরে উঠছ বাঙালীবাবু। আরো একটু বাকি–শোনো। তখন। আমার বয়েস বত্রিশ পেরিয়েছে। অর্থাৎ এলাহাবাদ ছাড়ার পর তের-চোদ্দ বছর কেটে গেছে। কিন্তু পুরুষ তুখনো আমাকে নিয়ে এমনি মত্ত যে বয়েস দেখার চোখ কারো। নেই। এদিক-থেকে ভুগর্বানের কিছু মাত্র কার্পণ্য ছিল না বলে বয়েস চোখে পড়ার কারণও নেই। সেবারে এক ধনীর দুলালের সঙ্গে এসেছি মধ্যপ্রদেশের কোনো এক জায়গায়। টাকার অঙ্ক সে-রকম হলে তাতেই বা আপত্তি কি? এ-রকম কত সময়। কত জায়গায় গেছি, ঠিক নেই।
জঙ্গলের মধ্যেই মাঝারি আকারের একটা ডাক-বাংলো। ফুর্তির জায়গা হিসেবে। আমার সঙ্গী সেই বাংলোটাই বেছে নিয়েছে। বাংলোয় আমি আর সে ছাড়া আর যে লোকটার অবস্থান, মানুষ না বলে তাকে জানোয়ারই বলা চলে। বছর সাঁইতিরিশ আটতিরিশ হয়তো বয়েস, পা থেকে গলা পর্যন্ত গরম কম্বল জড়ানো, মাথার চুল পিছন দিকে পিঠে এসে নেমেছে, আর গাল বোঝাই দাড়ি বুকের দিকে। গায়ের আর চুল দাড়ির রং মিলেমিশে একাকার। এখানে আসার পর এমনি হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়েছিল যেন জীবনে আর কখনো মেয়েছেলে দেখেনি। আমার সঙ্গী ধমকে উঠতে তবে সে আত্মস্থ হয়েছে।
লোকটা এই বাংলোর চৌকিদার।
আমরা বিকেলের দিকে এসেছি। দিন দুই থাকার ইচ্ছে। সন্ধ্যা নামতেই সঙ্গী মদের গেলাস নিয়ে বসেছে। ওরা যত মদ গেলে আমার তত সুবিধে। হামলা হুজ্জোত কম। হয়। ওকে সঙ্গ দেবার জন্য আমিও গেলাস নিয়ে বসেছি। আর খাচ্ছিও একটু বেশিই। সেই সঙ্গে গুনগুন করে রসের গানও গেয়ে উঠছি। এক-একবার উঠে নাচার চেষ্টাও করছি।
রাত তখন নটা-দশটার বেশি নয়। কিন্তু এখানে তখন নিঝুম রাত। খাওয়াদাওয়ার পরে আবার এক-প্রস্থ মদ গিলল লোকটা। তারপর আমার দিকে এগলো। ঘরে সবুজ আলো জ্বলছে। আমার ঘুম পাচ্ছে। কতক্ষণে অব্যাহতি পাব ভাবছি।
হঠাৎ ঠাস করে ঘরের ভেজানো দরজা দুটো খুলে গেল। কেউ যেন প্রচণ্ড এক লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলল। ঘরে এসে দাঁড়াল যমদূতের মতো সেই চৌকিদার। জন্তুর মতোই জ্বলছে তার দুটো চোখ। গায়ের কম্বল ফেলে এগিয়ে এসে আমার বুকের ওপর থেকে সঙ্গীকে যেন ছোঁ মেরে টেনে তুলে নিয়েই এক আছাড়। লোকটা আর্তনাদ করে উঠল। আমি কাঠ। যমদূতের মতো ওই চৌকিদার আবারও এগিয়ে গেল তার দিকে, আবারও টেনে শূন্যে তুলে নিল। তারপর তাকে নিয়ে চোখের পলকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি কাঁপছি থরথর করে। কি চায় লোকটা? কি মতলব ওর? একে একে দুজনকেই খুন করবে আমাদের?
একটু বাদেই মোটর স্টার্ট দেবার শব্দ কানে এলো। কি হল? আমাকে রেখে সঙ্গীকে গাড়িসুদ্ধ তাড়িয়ে দিল। ওই শীতেও আমি ঘামছি। শয্যায় উঠে বসে কাঁপছি।
সাক্ষাৎ যমের মতো ওই চৌকিদার ফিরল আবার। আমার দু হাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে মুখের দিকে অপলক চেয়ে রইল। এখন আর ওই দুটো চোখ জানোয়ারের মতো জ্বলছে না। তার বদলে গলগল করে যেন ঘৃণা ঠিকরোচ্ছে। সেই ঘৃণা আমার চোখে মুখে ঝাপটা মেরে যাচ্ছে।
কিন্তু এরকম অপলক চাউনি আমি আর কি দেখেছি? কার দেখেছি? কবে দেখেছি? কোথায় দেখেছি? এ কাকে দেখছি আমি? আমার সামনে দাঁড়িয়ে এ কে?
লোকটা নিজের মোটা ময়লা জামার পকেটে হাত ঢোকালো। কি যেন বার করল। তারপর সেটা আমার সামনে, সজোরে আমার বিছানার ওপর আছড়ে ফেলল।
জিনিসটা চিকচিক করে উঠল। দু চোখ বিস্ফারিত করে আমি দেখলাম একটা হার। আমার মায়ের দেওয়া সেই চুরি যাওয়া হার।
মুখ তুলে দেখলাম, লোকটা ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
এবারে চিনলাম। সেই মধু। সেই মধু যাদব।
তার পর থেকে বাঙালীবাবু, তুমি যা দেখলে আমি তাই। এক বছর বাদে। মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলের সেই বাংলোয় আর একবার গেছলাম মধুর খোঁজে। সে নেই। কোথায় গেছে কেউ জানে না। আমি এখনো গান গাই আর গোপাল পুজো করি। আমার গোপালের মুখ আর মধুর মুখ আজও মাঝে মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সেও কি পাপ?
আমি জানি না।
সোনালী রেখা
আত্মীয়-পরিজন সকলেই জানল রুচিরা জিতেছে। আনন্দে ডগমগ হবার মতো হারজিতের খেলা নয় এটা। এই হারজিতের ওপর স্বস্তি নির্ভর করছিল। শান্তি নির্ভর করছিল। তাই আনন্দে আটখানা না হোক, রুচিরা জেতার ফলে সকলে খুশী। সকলে বলতে একান্ত শুভার্থী জনেরা। বাবা-মা। দাদা-দিদি। নইলে খবরটা জানাজানি হবার। পর মুখ মচকাবে এমনও অনেকে আছে। রুচিরা ফিরে আবার গাঙ্গুলী হয়েছে এটুকুই তার জিত।
এতদিন ছিল রুচিরা ব্যানার্জী। মিসেস ব্যানার্জী। এখন এই দুপুরের পর থেকে আর মিস মিসেস কিছুই নয়। শুধু রুচিরা গাঙ্গুলী। সাতাশ মাসের একটা দুঃস্বপ্নের। শেষ। এই সাতাশ মাসের মধ্যে পনেরো মাস হাতে নোয়া বা শাখা ছিল না। কপালে। বা সিঁথিতে সিঁদুরও ছিল না। তবু অক্টোপাসের মতো দুটো ক্রুর লোলুপ হাতের অধিকার যেন ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ছিল।