কিশোর শেঠ কেন যে আসত আমিই শুধু ভালো বুঝতাম। এক-একদিন গাড়ি নিয়ে সে একটু দূরে অপেক্ষা করত। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চাইত। আমি তার সঙ্গে কথা বলতাম না, চোখ দিয়ে চাবকে অন্য দিকে ফিরে চলে আসতাম।
কলেজ যাবার সময়ও এক-একদিন তার গাড়ি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে যেত। গাড়িতে আমাকে কলেজে পৌঁছে দেবার জন্য অনুনয়ই করত। আমি ঝাঁঝিয়ে উঠতাম, ফের এ-ভাবে আমার পিছু নিলে মুশকিল হবে। কিশোর শেঠ হাসত, বলত, তুমি নারাজ, এর থেকে মুশকিল আর কি হতে পারে?
বড়লোক শিষ্যকে গুরু যে একটু বেশি খাতির করতেন সে আমার নিজের চোখেই দেখা। সেখানে বলে কিছু সুবিধে হবে না। বাড়িতে কৃষ্ণদার এই হাল। মাঝখান থেকে লোক জানাজানি হয়ে একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হবে। আমি রাগে ফুলতাম, কিন্তু সহ্যও করতে হত। লোকটারও মুণ্ডু যে ভালোভাবেই ঘুরেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গুরুর বাড়ির আর কলেজ যাওয়ার পথ যে আকুতি নিয়ে গাড়িতে বসে থাকত, তাই দেখে সময় সময় হাসিও পেত। আমাকে একটু চোখের দেখা দেখতে পেলেও যেন জীবন ধন্য ওর।
আমার সেই সংকটের সময় ওর কথাই মনে এলো আমার। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভাঙচুরের নেশা যেন পেয়ে বসল আমাকে। এই করলে বাবার ওপর শোধ নেওয়া হবে, পিসেমশাইয়ের ওপরেও।
সেদিনও কলেজের পথে কিশোর শেঠের গাড়ি দাঁড়িয়ে দেখলাম। সোজা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে তার পাশে বসলাম। এ-রকম ভাগ্য ওর কল্পনার বাইরে। আনন্দে ডগমগ হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কলেজে তো?
-না। যেখানে খুশি।
হাওয়ায় ভেসে চলল কিশোর শেঠের গাড়ি। আমি সোজা ঘুরে বসলাম তার দিকে। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি ঠিক ঠিক কি চাও বলো?
ও বলল, তোমাকে।
–বিয়ে করবে?
দম বন্ধ করে ও মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিল, করব।
–তোমাদের বাড়িতে আপত্তি হবে না?
মুখ কাচুমাচু করে ও বলল, তা একটু হবে হয়তো…।
-তাহলে?
— ও প্রাণপণে এই তাহলের জবাব হাতড়ে বেড়াতে লাগল। আমিই রাস্তা দেখালাম, আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে?
ও লাফিয়ে উঠল। তক্ষুনি রাজী। আমি বললাম, আজ নয়, সময়ে বলব। বাড়িতে বলে রেখো কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছ, নইলে তোমার বাড়ি থেকেও আবার। খোঁজাখুঁজি শুরু হবে। আর বেশ কিছুদিন চলার মতো টাকাকড়ি সঙ্গে নিও।
অত বলার দরকার ছিল না। ব্যবস্থামতো আমরা চলে এলাম বেনারসে। এক নাগাড়ে কোথাও বেশিদিন থাকতাম না। ইউ পি-র সর্বত্র প্রায় মাসখানেক ঘোরাঘুরি করে কাটল। কিশোর শেঠ আমার কেনা গোলাম যেন। যা বলি তাই শোনে। আমার একটু সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আর আনন্দের জন্য দেদার খরচ করে। ওকে যতটুকু পাগল করা দরকার করেছি। বিকেল হতে না হতে রাতের প্রত্যাশায় বসে থাকত। কিন্তু বিয়ের কথা তুললেই ওর মুখ ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে যেত। বলত, হবে, খুব শীগগিরই হবে, তুমি অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন?
আমার সন্দেহ বাড়তে থাকল। শেষে জেরার ফলে একদিন ধরা পড়ে গেল। দু-বছর আগেই ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে বউ আছে। হাঁটু গেড়ে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরে ওর সে-কি আকুতি। বিয়ে করলেও আমিই ওর ধ্যান জ্ঞান, আমিই সব। বিয়ে ও আমাকে ঠিকই করবে, কিন্তু তার আগে সব দিক গুছিয়ে নেবার জন্য ওর কিছু সময় দরকার।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙেছে। ওর বুকে একটা ধারালো ছোরা বসিয়ে দিতে পারলে মন ঠাণ্ডা হত। সেই রাতে আমার শয্যার দিকে ওকে ঘেঁষতে দিলাম না। সমস্ত রাত বসে ভাবলাম। একদিন ওই কিশোর শেঠ আমাকে ছেড়ে চলে যাবে ঠিক জানি। কিন্তু তার আগে ওকে অবলম্বন করেই আমাকে দাঁড়াতে হবে, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে। এটুকু যদি না পারি, আমার রূপ যৌবন চোখের আগুন। সব মিথ্যা।
পরদিনই আবার ওকে কাছে টেনে নিলাম। খুব হাসলাম। খুব আদর করলাম। বললাম, তুমি এত ছেলেমানুষ আমি জানতাম না, প্রথমেই সব আমাকে খুলে বললে পারতে–সত্যিকারের ভালবাসার মানুষকে ওটুকুর জন্যে কেউ কি ফেলে দিতে পারে, না কি সত্যিকারের ভালবাসা সমাজসংসারের পরোয়া করে?
কিশোর শেঠ বর্তে গেল।
আমি আরো নিশ্চিন্ত করে দিলাম তাকে। বললাম, যাকগে, বিয়ের ভাবনা আর তোমাকে ভাবতে হবে না, আমি তোমার প্রেয়সী হয়েই থাকব–কিন্তু তুমি আমাকে তোমার রুচির যোগ্য করে তোলো, এই যৌবনের ফুল শুধু তোমার জন্যেই যেন সম্পূর্ণ হয়ে ফুটতে পারে সেই ব্যবস্থা করো।
ব্যবস্থাটা কি প্রথমে বোঝেনি, পরে বোঝার পর আনন্দে আত্মহারা হয়েছে। হবে না কেন, টাকার তো অঢেল জোর। ওকে নিয়ে আমি লক্ষ্ণৌ চলে এসেছি। সেখানে অনেক খরচ করে গুণী ওস্তাদ রেখে আবার গান বাজনার তালিম নিতে শুরু করেছি। নাচও বাদ দিইনি। নামী বাঈজীর কাছে সহবৎ শিক্ষা করেছি। না, বোকার মতো কিশোর শেঠকে আমি সেখানে আটকে রাখিনি। সে তারই ইচ্ছে মতো বাড়িতে গেছে,এসেছে। যখনই এসেছে দু পকেট বোঝাই টাকা এনেছে। আমি অম্লান বদনে সে-টাকা নিজের দখলে রেখেছি, আর প্রতি বারের থেকে প্রত্যেক বারে বেশি প্রেমের অভিনয় করেছি। ওকে পাগল করাটাই আমার লক্ষ্য। পাগল করেছি।
খুব বেশি সময় লাগেনি। গলা তো অনেকটা তৈরিই ছিল, বছর চারেকের মধ্যেই আমাকে নিয়ে টানাটানি পড়তে লাগল। আমার রূপ যৌবন কটাক্ষ সবই কাজ করত, ফলে টাকাও বেশি পেতাম। নাচ গান তো আছেই, আরো প্রত্যাশায় টাকার মানুষেরা। পায়ে এসে গড়াগড়ি খেত। প্রাপ্যগণ্ডা মনের মতো হলে তাদেরও করুণা করতে আমার আপত্তি হত না। আমার ভিতরে সেই থেকেই শুধু ধ্বংসের আগুন জ্বলছে। সেই আগুনে নিজেকে পোড়ানো আর মত্ত উল্লাসে পুরুষ পোড়ানোই একমাত্র লক্ষ্য। সে-সময়ে যদি তোমার দেখা পেতাম বাঙালীবাবু, তাহলে তোমারও কি সর্বনাশ যে হত কে জানে। কৃষ্ণদা অনেক আগেই মারা গেছে সে-খবর কিশোর শেঠ আমাকে এনে দিয়েছিল। আমার কাছে দুনিয়ার বাকি সব পুরুষ নরকের জীব। তারা যত বেশি জ্বলবে আমার তত উল্লাস।