কিন্তু এখানেও নিজের বাবার মতোই একজনকে আমি ঘৃণা করতে শুরু করলাম। সে কৃষ্ণকুমারের বাবা। আমার পিসেমশাই। তার সেই বড় আদরের বন্ধু যজ্ঞেশ্বরবাবুকে নিশ্চয় মনে আছে তোমার? বয়সে পিসেমশাইয়ের থেকে পাঁচ-ছ বছরের ছোট, পিসেমশাইকে দাদা-দাদ করত। পয়সাঅলা মানুষ, আমি এলাহাবাদে আসার আগেই তার বউ মরেছে শুনেছিলাম। তখন উনিশ পেরিয়ে সবে কুড়িতে পা দিয়েছি আমি, বোনকে একদিন আমাকে দেখাতে নিয়ে এলো যজ্ঞেশ্বরবাবু। ওই বোনের ছেলে মস্ত সরকারী চাকুরে, তার বিয়ে দেওয়া হবে। ভালো মেয়ে চাই। দাবিদাওয়া নেই। পিসেমশাই আর পিসির অনুরোধ ঠেলতে না পেরে যজ্ঞেশ্বরবাবু বোনকে নিয়ে এলো মেয়ে দেখাতে। মানে আমাকে দেখাতে। আমি জোর করে বলতে পারি সেই বোনের আমাকে পছন্দ হয়েছিল। নানাভাবে আমাকে যাচাই করে দেখে আর গান শুনে খুশীতে আটখানা হয়ে চলে গেছল। কিন্তু পরে গম্ভীরমুখে পিসেমশাই এসে খবর দিল তার নাকি মেয়ে পছন্দ হয়নি।
পছন্দ না হওয়ার কারণটা দুদিন না যেতেই বেশ বোঝা গেল। সন্ধ্যায় পিসেমশাই কেমন যেন চুপিচুপি এক জায়গায় যেতে হবে বলে আমাকে ধরে নিয়ে গেল। রাস্তায়। বলল, যজ্ঞেশ্বরের শরীরটা ভালো না, তোর গান শোনার ইচ্ছে হয়েছে, তাই
তখনো সাদা মনেই গেছি আমি। বিরাট চক-মিলানো দালান। যজ্ঞেশ্বরবাবুর ঐশ্বর্যের কথা বলতে বলতে পিসেমশাই আমাকে তার কাছে নিয়ে গেল। যজ্ঞেশ্বরবাবুর ছেলে তিনটে কাছাকাছিই ছিল, বড় ছেলেটা আমার থেকে বড় হবে বয়সে–সে আমাকে চোখ দিয়ে গিলতে গিলতে আর একদিকে চলে গেল।
যজ্ঞেশ্বরবাবুকে একটুও অসুস্থ মনে হল না আমার। দিব্যি হাসিখুশি ফুর্তির মেজাজ। আমাকে আর পিসেমশাইকে একরাশ খেতে দিল। তারপর গান নিয়ে বসলাম। গাইতে গাইতে ওই লোকটার সঙ্গে বার কয়েক চোখাচোখি হতেই আমার মনে হল কিছু একটা গোলমেলে ব্যাপারের মধ্যে পড়তে চলেছি। গান একটুও ভালো হল না। কিন্তু যজ্ঞেশ্বরবাবু প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একে একে অনেকগুলো গান গাইয়ে ছাড়লে।
ফেরার সময় পিসেমশাই আমাকে খোলাখুলি যা বলল, তার সার কথাযজ্ঞেশ্বরের মতো অত ভালো লোক আর হয় না, যেমন পয়সা তেমনি দরাজ মন। বয়েস একটু হয়েছে, তাও পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশের মধ্যে–ব্যাটাছেলের সেটা এমন কিছু বয়েস নয়। তার খুব পছন্দ তোকে, রানীর হালে থাকবি-মাথা ঠাণ্ডা করে ওকেই বিয়েটা করে ফেলা উচিত।
শোনার পর সর্বাঙ্গ রি-রি করে উঠল আমার। জবাব না দিয়ে আমি শুধু মাথা নাড়লাম। অর্থাৎ তা হবে না।
তাইতেই পিসেমশাই রেগে উঠল। আমার অবাধ্য হবি? আমি তোর ভালো বুঝি না?
আমাকে চুপ দেখে একরকম শাসিয়েই দিল তারপর। যা হবার পরে ভেবে চিন্তে হবে, কিন্তু এ নিয়ে যেন বাড়ির কাউকে একটি কথাও না বলি।
তার ভয় কৃষ্ণদাদাকে। কিন্তু তাকেও কিছু বলতে পারা গেল না। বললে কতবড় অশান্তির সৃষ্টি হত জানি। আর তখন কৃষ্ণদার যা শরীরের হাল।
কদিন না যেতে পিসেমশাই আবার আর একদিন যজ্ঞেশ্বরবাবুর বাড়ি নিয়ে যেতে চাইল। আমি গেলাম না। পিসেমশাই রাগে ফুঁসতে লাগল। এর একদিন পরেই যজ্ঞেশ্বরবাবু বাড়ি এসে হাজির। পিসেমশাইও ঘটা করে তার আদর আপ্যায়ন করল। তারপর আমার ডাক পড়লো, গান শোনাতে হবে। কৃষ্ণদাই আমাকে ঠেলে পাঠালো, ভদ্রলোক এসেছেন বাড়ি বয়ে, গান শোনাবি না তো গান শিখিস কেন?
এক ঘণ্টা ধরে গান হল। আর সেই এক ঘণ্টা ধরে দুই চোখ দিয়ে আমার শরীরটা যেন চেটেপুটে খেল যজ্ঞেশ্বরবাবু। চলে যাবার পর পিসেমশাই আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে প্রায় শাসিয়েই দিল, আমার অবাধ্যপনা বরদাস্ত করা হবে না, দুদিন আগে হোক পরে হোক বিয়ে ওখানেই হবে। তোর পিসিকেও আমি বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজী করিয়েছি–এর থেকে ভালো যে আর কিছু হয় না সেটা সেও বুঝেছে। আর তার শেষ কথা, ছেলে এখন অসুস্থ, তাকে যেন এখন এসব কথা শুনিয়ে একটুও বিরক্ত না করা হয়। আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে এটুকুই তার নির্দেশ।
আমি চারদিকে তখন অন্ধকার দেখছি। এর ওপর পরদিনই আবার কৃষ্ণদার গলগল করে রক্ত পড়ল গলা দিয়ে। আমার মনে হল কৃষ্ণদা দশ-বিশ দিনের মধ্যেই চলে যাবে। তারপর? ওই পিসেমশাই আর ওই যজ্ঞেশ্বরের হাত থেকে কে আমাকে রক্ষা করবে? বিশ্বাস করো বাঙালীবাবু, আমার তখন প্রথমেই তোমার কথা মনে হয়েছিল। তোমাকে ভালো লাগে, বাঁচার তাগিদে তোমাকে নিয়ে পালাতে আমার একটুও আপত্তি হত না। আর সেভাবে আঁকড়ে ধরতে পারলে তুমিও আমাকে ছাড়তে পারতে না। কিন্তু তারপরেই মনে হল, তোমার অন্য রকম সমাজ, অন্য রকম পরিবার। আমার প্রতি তোমার একটু দুর্বলতা আছে বলে এমন একটা শাস্তি তোমার ওপর চাপিয়ে দেব! নিজের সমাজ, সংসার থেকে বঞ্চিত হয়ে একদিন তুমিই কি আমাকে ঘৃণা করবে না?
তোমাকেও বাতিল করে দিলাম। তখন থাকল আর একজন। তার খবর তোমরা কেউ রাখো না। তার নাম কিশোর শেঠ। যে ওস্তাদের কাছে আমি গান শিখতাম, তারই আর এক শিষ্য। মাখনখানার মতো চেহারা। দুহাতের পাঁচ আঙুলে পাঁচটা আংটি ঝকমক করত। জামায়ও হীরের বোতাম পরত। নিজের ঝকমকে একখানা গাড়ি হাঁকিয়ে আসত সে। আমার সপ্তাহে যে দুদিন গান শেখার পালা, তার সেদিন আসার কথাও নয়। কিন্তু দু-চারবার দেখা হয়ে যাওয়ার পর ক্রমে দেখা গেল ওই দু-দিনই সে সব থেকে নিয়ম করে আসত। গুরুর কাছে আসবে, তালিম দেওয়া শুনবে–তাতে আর কার কি বলার আছে। তাছাড়া ওই ওস্তাদের মতো ভালো মানুষও কম হয়।