ঝুমরি…।
চমকে ফিরে তাকালো। তারপর হেসেই ফেলল। বলল, বাইশ বছর বাদে এ ডাক শুনে ভয়ানক চমকে গেছলাম।
চললে?
–হ্যাঁ।
এগিয়ে এলো। হাসছে তখনো।–ঠিক আছে। তোমার খাবার নিয়ে সকালে ঠিক সময়ে আমি স্টেশনে যাবখন।
এসেছে। একলাই। ট্রেন ছাড়তে তখন আর মিনিট দশেক মাত্র বাকি। খাবারের পাত্রটা জায়গা মতো রেখে এ-দিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, জল কোথায়?
–আছে। বসো তুমি। আমি ভাবলাম আর এলেই না।
কুপেতে তখন পর্যন্ত আমি একা। আমার হাতখানেক তফাতে বসে সুলক্ষণা বলল, তোমাদের তো ওই রকমই ভাবনার দৌড়।..কলকাতায় পৌঁছে চিঠি দেবে তো?
–চিঠি দিলে জবাব পাব?
হাসিমুখেই মাথা নাড়ল, তা অবশ্য পাবে না। আচ্ছা তোমাকেও চিঠি লিখতে হবে না, দেখা হল, এই ভালো। গোপালের দয়ায় নিরাপদে পৌঁছুবে জানিই তো।
ঘড়ি দেখলাম। আর পাঁচ মিনিট মাত্র বাকি। অভিমানহত সুরে বললাম, আমারই শেষ পর্যন্ত কিছু জানা হল না।
-হবে, হবে। হাতের ঝোলা খুলে বাদামী রংয়ের বড় খাম বার করল একটা।-তুমিও যেমন, এ-সব কথা মুখে বলা যায় নাকি! খামটা হাতে দেবার আগে থমকালো একবার।–কিন্তু একটা কথা, আমাকে নিয়ে কোথায়ও কিছু লিখবে না!
–কেন?
লিখলে তুমি ঠিক আমাকে বাড়াবে জানি। সব কবুল করতে পেরে আমার মনে একটু শান্তি এলো–ব্যস, এর বেশি আর কিছু চাই নে। রাস্তায় যেতে যেতে পড়বে, তারপর ছিঁড়ে কুচি কুচি করে জানলা দিয়ে ফেলে দেবে। ঠিক তো?
হাত বাড়িয়ে ওর হাত থেকে খামটা নিলাম। বললাম, সেটা না পড়া পর্যন্ত বলতে পারছি না–তবে বাড়াবো না, কথা দিলাম।
ঘড়ি ধরে গাড়ি ছেড়েছে। তার আগে সুলক্ষণা নেমে জানলার কাছে দাঁড়িয়েছে। চলন্ত ট্রেন থেকে যে কয়েক সেকেন্ড দেখা গেছে তাকে, দেখেছি। তারপর খাম খুলে বসেছি।
কথার খেলাপ করব না। বাড়ানোর ভয় আছে বলেই, সুলক্ষণা দয়াল যা লিখেছে। সেটুকুই শুধু তুলে ধরছি।
বাঙালীবাবু রাতে যাবার আগে তুমি ঝুমরি বলে ডাকলে, আমারও বাইশ বছর আগের প্রিয় নামে তোমাকে ডাকার সুবিধে হয়ে গেল। আমার মেয়েদের কাছে এ. কদিন তোমাকে বাঙালীবাবুই বলেছি, আর আমার নিজেরই দু কান যেন ভরে গেছে।
তোমার অনেক জানতে চাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বড় নোংরা ব্যাপার সব। সাধকরা বলেন, পাপ ধুয়ে ফেলতে চাও তো পাপ স্বীকার করো। কিন্তু কার কাছে স্বীকার করব? ঘরের দেওয়ালের কাছে? তোমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তোমার জানার লোভ থেকে আমার জানানোর লোভটা কম ছিল না। কিন্তু দোহাই তোমার, সবটুকু পড়ার আগেই ঘেন্নায় ছিঁড়ে ফেলে দিও না।
..জীবনে প্রথম যে মানুষকে দেখলে আমার দুচোখ ঘৃণায় ঠিকরতো, আর মাথায় খুন চাপতো, সে আমার বাবা। একদিন আমি এই বাবাকেই দুনিয়ার সেরা সুন্দর পুরুষ ভাবতাম। বাবা যখন গান-বাজনা নিয়ে বসত, আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম আর ভাবতাম ওরকম গানের আসরে কবে আমারও জায়গা হবে।
বাবা মদ খেত তাও আমার কাছে খুব একটা দোষের কিছু নয়। মা রাগ করত, আর আমি ভাবতাম মা-ই ইচ্ছে করে ঝগড়া বাধায়। আমার পনের বছর বয়সের সময় মায়ের শরীর একেবারেই ভেঙে গেল। চড়া ডায়বেটিস। উঠতে বসতে মাথা। ঘোরে। একদিন বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। বাড়িতে কেউ নেই, উৰ্বশ্বাসে আমি ছুটলাম দুর্গা মাসির বাড়ি। বাবা সেখানে আড্ডা দিতে যায়। এই দুর্গা মাসির সম্পর্কেও পাড়ার লোকে ভালো বলে না। দুর্গা মাসির কেন বিয়েই হল না, তাই নিয়েও এক-একজন এক-এক রকম বলে। কিন্তু ও-সবেও আমি কান দিই না। কারণ দুর্গা মাসি হাসে খুব, আমি গেলে আদর করে কাছে টেনে নেয়। ভালো ভালো খেতে দেয়।
বাড়ি থেকে পনের মিনিটের হাঁটা পথ এক ছুটে চলে এসেছি। বেদম হাঁপাচ্ছি। কিন্তু দুর্গা মাসির বাড়ি এসে মনে হল, কেউ নেই। দুটো ঘরই অন্ধকার। সামনের ঘরের দরজা খোলা, পিছনের অর্থাৎ দুর্গা মাসির ঘরের দরজা ভেজানো। ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালোম।
তারপরে কয়েক পলকের জন্য যেন পাথর আমি। কি দেখলাম তা আর বলে কাজ নেই। ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম আবার। আরো দ্বিগুণ ছুটে সোজা বাড়ি। এর মধ্যে বিকেলের ঠিকে ঝিটা এসেছিল। মাকে ওই অবস্থায় দেখে সেই পাড়ার লোক ডাকাডাকি করে তাকে ঘরে এনেছে।
আমি সে-ঘরেও আর থাকতে পারলাম না। বাইরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। সমস্ত পৃথিবীটা আমার কাছে একটা দগদগে ঘায়ের মতো বীভৎস লাগছে।
মিনিট কুড়ির মধ্যে বাবা এলো। এসেই আমার গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিল। এমন চড় যে আমি ঘুরে পড়ে গেলাম।
মা আর সে-যাত্রা রক্ষা পেল না। তার তিন মাসের মধ্যে বিয়ে করে বাবা দুর্গা মাসিকে ঘরে নিয়ে এলো। দুর্গা মাসি গোড়ায় গোড়ায় আমার মন পেতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাকে দেখলেই আমার দুচোখে গলগল করে ঘৃণা ঠিকরতো। ফলে বাবা আমাকে শাসন করত। তার ফলও উল্টো হত।
ভালবাসা ঠিক কাকে যে বলে আমি তখনো জানি না। শুনলে তুমি কানে আঙুল দেবে কিনা জানি না, আমার জীবনে প্রথম ভালবাসার মানুষ কৃষ্ণদাদা। ওই কাজিন বিয়ে না কি বলে, আমাদের সমাজে সেটা চালু থাকলে যে করে তোক কৃষ্ণদাকে নিয়ে আমি পালাতাম, প্রাণ দিয়ে চিকিৎসা করতাম, তাকে ভালো করে তুলতাম। কৃষ্ণদাদার ঝাঁঝরা বুকের সঙ্গে নিজের বুকটা বদলাবদলি করা সম্ভব হলে তাও করতাম বোধহয়। আমার ভালবাসা কৃষ্ণদাকে শুধু সুস্থ করে তুলতে চেয়েছে, আর কিছু না। এই ভালবাসা কি পাপ?