- বইয়ের নামঃ সোনালী রেখা
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
সুলক্ষণা
পাঠক ধরে নেবেন না একটা গল্প লেখার তাগিদে বাইশ বছর বাদে শেষে হরির দুয়ারে এসে তার সঙ্গে হঠাৎ এভাবে দেখা হয়ে গেল। হরির দুয়ার বলতে হরিদ্বার। আর তার সঙ্গে মানে সুলক্ষণা দয়ালের সঙ্গে। খবরটা আমাকে দিয়েছিল ছেলেবেলার বন্ধু জয়ন্ত রঙ্গ। নতুন বয়সের কালে কোনো রাজনীতির দলে ভিড়েছিলাম। হালকা গোছের ব্যাপার সেটা। তবু উৎসাহ আর উদ্দীপনা কম ছিল না। জায়গাটা এলাহাবাদ। সর্ব ব্যাপারেই বেশ নিরাপদ গোছের পটভূমি। শাসক দলের সব কাজে প্রতিবাদের ঝড় তুললেও গর্দান যাবার ভয় ছিল না। এমন কি হাজত বাসের ঝুঁকিও যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতাম। বেকার জীবনের স্বল্পমেয়াদী শৌখিন রাজনীতির অধ্যায় বললে যতটুকু বোঝায়। যুক্তির থেকে তর্কের ঝোঁক বেশি ছিল। শোনার থেকে শোনানোর।
জয়ন্ত রঙ্গ সেই সময়ের আর সেই দলের অন্তরঙ্গ একজন। পেশার ক্ষেত্রে এখনো সতীর্থই বলা চলে তাকে। ইউ. পি-র এক নামী কাগজের হোমরাচোমরা সাংবাদিক। বছরে দু-একবার কলকাতায় আসে। তখন দেখা হয়। মন-খোলা গল্পও হয়। গেল মাসে এসেছিল। খবরের কাগজের মানুষ। প্রথমেই জোরদার খবর দেবার মতো করে বলল, মাঝে দিন কয়েকের জন্য হরদোয়ার বেড়াতে গেছলাম, সেখানে হর কী পিয়ারার ঘাটে হঠাৎ তোমার সুলক্ষণার সঙ্গে দেখা
কার কথা বলছে বা কি বলছে ভেবে না পেয়ে আমি অবাক একটু।আমার সুলক্ষণা। সে আবার কে?
চোখ পিটপিট করে জয়ন্ত বলল, ক্যা তাজ্জব কি বা–এলাহাবাদের সেই সুলক্ষণা দয়াল-কৃষ্ণকুমারের বোন-ভুলে গেলে? তোমার সেই ঝুমরি।
শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মগজের মধ্যে একটা ওলটপালট কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। যার ফলে তখনো বোধ হয় হাঁ করে চেয়েই ছিলাম ওর দিকে। এবারে হালছাড়া গলায় চোস্ত উর্দুতে জয়ন্ত রঙ্গ রসিকতা করে উঠল, কি রকম রসের কারবারী তুমি, যে মেয়ের মন পাবার জন্য আমাকে কাটতি দিয়ে গায়ে আতর মেখে দু বেলা কৃষ্ণকুমারের বাড়ি পলিটিক্স কপচাতে যেতে, আর হঠাৎ নিপাত্তা হয়ে যেতে যার। খোঁজে তামাম এলাহাবাদ চষে বেড়িয়ে শেষে আমার গলা চেপে ধরলে–সেই পহেলী চিড়িয়াকে বেমালুম ভুলে মেরে দিলে।
ভুলিনি। বিস্মরণের পলস্তরা পড়ে ছিল। শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাইশ বছরের একটা ভারী পর্দা চোখের সামনে থেকে সরে গেছে। এক বাড়ির মেয়ে পুরুষ ছেলে বুড়ো সক্কলের গায়ের চামড়া চোখে লাগার মতো ধপধপে ফর্সা। সকলের মধ্যে ব্যতিক্রম শুধু উনিশ-কুড়ি বছরের একটি মেয়ে। যার গায়ের রঙ ফর্সা নয়। তা বলে কালোও ঠিক নয়। কিন্তু বাড়ির লোকের পাশে কালোই দেখাতো। বাড়ির মানুষেরা তার গায়ের রং নিয়ে খুঁতখুঁত করত। কিন্তু সেই মেয়ের আয়তপক্ষ্ম নিবিড় কালো চোখের তারায় আমি যে আলো ঠিকরোতে দেখেছি, আর তার সুচারু দুই ঠোঁটের ফাঁকে যে অধরা হাসির ঝিলিক দেখেছি, এই খুঁতখুঁতুনির কথা শুনলে বাড়ির মানুষগুলোকে আমার অন্ধ মনে হত। কৃষ্ণকুমার অবশ্য বলত, ঝুমরির গায়ের রং একটু চাপা হলেও অমন রূপ কটা মেয়ের হয়। এরা সব মিথ্যে ভাবে, ওর খুব ভালো বিয়ে হবে আমি বলে দিলাম।
ঝুমরি বা সুলক্ষণা কৃষ্ণকুমারের মামাতো বোন। এ-বাড়ির সমাদরের আশ্রিতা। বছর দুই আগে কলেজে পড়ার নাম করে বাপের বাড়ির সংস্রব ছেড়ে এলাহাবাদে পিসির কাছে চলে এসেছিল। কলেজে পড়ছিলও। কিন্তু পড়াশুনায় তেমন মতি আছে। আমার মতো নীরব ভক্তও সে-কথা বলবে না। কৃষ্ণকুমার বলত, ঝুমরির মাথা খুব, একটু পড়লেই ভাল রেজাল্ট করতে পারে, কিন্তু পড়তে ডাকলেই ওর গায়ে জ্বর আসে
যেটুকু বলত তার থেকেও বেশি বিশ্বাস করতাম আমি। ঝুমরির মাথা খুব, বুদ্ধি ধ্ব। এত বুদ্ধি আর এত মাথা বলেই যেন ওর নিয়ম করে কৃষ্ণকুমারের কাছে বই। নিয়ে বসার দায়টাকে বড় কর্তব্য ভাবতাম না। ওর নাম সুলক্ষণা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সবটকই যেন তাই। আবার সুলক্ষণার ভিতরটা যদি নদীর মতো খরস্রোতা হয় তাহলে ওই পোশাকী নাম ছেড়ে ঝুমরি নামটাই যেন সব থেকে মানায় ভাল। আমার চোখে ও আড়াল হলে সুলক্ষণা, সামনে এলে ঝুমরি।
বাড়ির লোকের অবিবেচনাপ্রসঙ্গে কৃষ্ণকুমার ওর রূপের কথা তুললে ঝুমরি মিটিমিটি হাসত আর আড়ে-আড়ে আমাকে লক্ষ্য করত। আমার মুখ থেকে নীরব সমর্থন ভিন্ন কোনো রকম মন্তব্য আশা করত না। দু-একটা কটাক্ষেই বুঝে নিত ভিতরে ভিতরে কতগুণ বেশি, সায় দিলাম। তারপর আরো বেশি মজা পেত যেন। চোখের তারায় আর ঠোঁটের ফাঁকের হাসির ছোঁয়াটুকু আরো তীক্ষ্ণ মনে হত, তখন। ফাঁক পেয়ে চাপা ঝাঝালো গলায় ঝিলিক তুলে একদিন আমাকে বলেছিল, আমার চেহারা নিয়ে কৃষ্ণদার তোমার কাছে মাথা ব্যথা কেন–আমাকে ভেতো বাঙালীর কাছে গছাবার মতলব নাকি!
জবাব হাতড়ে না পেয়ে হাসতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমার বুকের তলায় যে ঝড় উঠেছিল সেও ওই মেয়ে ঠিকই আঁচ করেছিল মনে হয়।–
কৃষ্ণকুমারের মনে মুখে লাগাম নেই। ঝুমরির দুঃখের খবরও শুনিয়েছে আমাদের। আর একই প্রসঙ্গে নিজের মামারও রূঢ় সমালোচনা করেছে। মামার শিক্ষা-দীক্ষা আছে, কিন্তু স্বভাব-চরিত্র ভাল নয়। হৃদয় বলেও কিছু নেই। মামাটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে অকালে চোখ বুজেছে। বছর না ঘুরতে মামা একটা বাজে মেয়েছেলেকে বিয়ে করে ঘরে এনে তুলেছে। দুজনে মিলে মেয়েটাকে নির্যাতন করত। কিন্তু ঝুমরি মায়ের মতো মুখ বুজে সহ্য করার মেয়ে নয়। স্কুলের পরীক্ষা সারা হতেই এক জামাকাপড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। এলাহাবাদ থেকে খবর যেতে মারমুখী বাপ মেয়েকে শাসন করতে আর নিয়ে যেতে এসেছিল। সেই মামাকে কৃষ্ণকুমার বলতে গেলে ঘাড় ধাক্কা দিয়েই তাড়িয়েছে। রাজনীতিতে কৃষ্ণকুমার আমার থেকে অন্তত ঢের বেশি মাথা গলিয়েছিল। টানা ছমাস জেলও খেটেছে একবার। তাছাড়া তখনো কাল রোগে ধরেনি তাকে। নীতিগত ব্যাপারে সেই নরম-সরম মিষ্টি ছেলেটার এক ধরনের অনাপোস মেজাজ ছিল। গোঁ ছিল। ফলে আত্মীয় পরিজনেরা বেশ সমীহ করে চলত তাকে। মামা সেই যে প্রস্থান করেছে আর কোনোদিন মেয়ের খোঁজও নেয়নি।