কিন্তু এখানে চোখ-কান-মন ভরে ওঠার মত সবকুটুই গান। কোনো আবেগের মুখে স্থির শিল্পী হয়তো কখনো একটু দুলে উঠল, কোনো হালকা রসাবেদনের মুখে হয়তো মৃদু মৃদু হাসতে লাগল, কোনো দ্রুত বিন্যাসের মুখে তবলচির আসুরিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে গানের মধ্যেই ফিক করে হেসে উঠল কখনো। এই আসরে শোনার থেকেও সঙ্গীতের এক মূর্তিমতী রূপ সুসম্পূর্ণ।
গান শেষ। আবার অনুরোধের সুযোগ না দিয়ে মহিলা সোজ। উঠে পড়ল। প্রস্থানের ভঙ্গী দ্রুততর। এবারে দ্বিগুণ হাত-তালি। আবার আমি নীরবে সারাভাইকে খুজলাম একপ্রস্থ। চোখে পড়ার আগে পিঠে খোঁচা।
ত্রিপুরারির উদ্ভাসিত মুখ।–কেমন শুনলে?
কৃতিত্বটা যেন তারই।
জবাব দেবার অবকাশ পেলাম না। অনেকের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরারিরও সামনের দিকে দৃষ্টি ঘুরেছে। আগের মতই পরিচিতদের উদ্দেশে হাত তুলে নমস্কার জানাতে জানাতে হাসিমুখে ডায়াসের লাগোয়া সারি থেকে এদিকে আসছে শঙ্কর সারাভাই। বলা বাহুল্য, এই আসা এবং এই নমস্কার বিদায়সূচক।
যশোমতী পাঠক তার পূর্বাসনে। তার পাশ দিয়েই শঙ্কর সারাভাই এগিয়ে এলো। দেখলাম, সে একনজর তাকালো মহিলার দিকে। কিন্তু মহিলার দৃষ্টি সামনের ডায়াসের দিকেই। সেখানে মন্ত্র-সঙ্গীত, অর্থাৎ সেতার-বাদনের তোড়জোড় চলেছে। রমণীর হৃদয় যন্ত্ৰ গোটাগুটি নির্লিপ্ত।
–সার।
ত্রিপুরারি তখনো পাশে দাঁড়িয়েই ছিল। তার বিনয়-বিগলিত আহ্বানে আমার রমণীর রীতি দেখার একাগ্রতায় ছেদ পড়ল। ঠিক পথ আগলে নয়, একটু পথ ছেড়ে দিয়েই কাজের উদ্দেশে ত্রিপুরারির এই সসম্ভম আহ্বান।
মিলিয়নেয়ার মিল-ওনার শঙ্কর সারাভাই দাঁড়িয়ে গেল। ব্যস্ত-সমস্ত ত্রিপুরারি এবারে শশব্যস্তে আমার হাত ধরে এক টান। তার পরেই গড়গড় করে আমার পরিচয় দিয়ে গেল। সেই পরিচয় শুনলে যে-কোন লেখক ওকে প্রচার-সচিবের পদে বহাল করার ইচ্ছেটা মনে মনে অন্তত পোষণ করবে। সারাভাইয়ের সঙ্গে ত্রিপুরারি কথা বলল হিন্দীতে। এরই ফাঁকে আমি যে ওর ছেলেবেলার একাত্ম বন্ধু–সেই সমাচারও অব্যক্ত থাকল না। আর অবশেষে লেডি অর্থাৎ যশোমতী পাঠকের সনির্বন্ধ অনুরোধ এবং একান্ত আগ্রহে আমার এখানে পদার্পণ–এটুকুর মধ্যে সেই অতিশয়োক্তিও অনুক্ত রইল না।
ত্রিপুরারির বেপরোয়া প্রশংসা বচনে অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমার একটা হাত ভদ্রলোকের পুষ্ট দুই হাতের থাবার মধ্যে চালান হয়ে গেল এবং গোটা দুই ঝাঁকুনি পড়ল।
–সো গ্ল্যাড টু মিট ইউ।
আমার পাল্টা বিনয়োক্তি। কিন্তু ভদ্রলেকের তুলনায় সেটা অনেক ক্ষীণ। হিন্দীর সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে শঙ্কর সারাভাই তড়বড় করে বলে উঠল, কত দূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন, উই আর রিয়েলি সস হ্যাপি। আপনারা গুণী লোক, কিন্তু বড় আফসোেস এই গুণের খবর আমি কিছুই রাখি না। রাখেন যিনি তিনি ওই যে–উনিই আপনাদের রিয়েল অ্যাডমায়ারার!
আঙুল দিয়ে অদূরবর্তিনী মহিলা, অর্থাৎ সশোমতকে দেখিয়ে দিল। ত্রিপুরারিকে জিজ্ঞাসা করল লেডির সঙ্গে আমার এক আধ দিন সাহিত্য-চৰ্চা হয়েছে কিনা। হয়নি শুনে একদিন নিয়ে যেতে পরামর্শ দিল, তারপর শুভেচ্ছা জানিয়ে হাসিমুখে প্রস্থান করল।
মনের আনন্দে ত্রিপুরারি কি বলে যাচ্ছে কানে ঢোকেনি। আমার দৃষ্টি এই সামনের দিকে দু’সারি আগের আসনের দিকে। একটানা এতক্ষণ গানের পর মহিলার বসার শ্রান্ত ভঙ্গিটুকুও মিষ্টি। গান শেষ হতেই বিশিষ্ট ব্যক্তিটি যে প্রস্থান করল সে সম্বন্ধেও তেমন সচেতন মনে হল না। ত্রিপুরারি বকেই চলেছে। আমার অভিলাষ নিজের কাছেই প্রায় অগোচর তখনও।
যন্ত্রসঙ্গীতের কদর কণ্ঠসঙ্গীতের তুলনায় কম-বেশি সর্বত্রই এক রকম। শুধু শঙ্কর সারাভাই নয়, অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শেষ হবার আগেই অনেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, অনেকে চলে যাচ্ছে। যশোমতীর পাশের আসনে বসে ছিল এক স্থানীয় বৃদ্ধা। কে জানি না। সেও উঠল এবং দরজার দিকে পা বাড়াল। আর সঙ্গে সঙ্গে দম ফুরানে। যন্ত্রের মত ত্রিপুরারির মুখের কথা অসমাপ্ত থেকে গেল। কারণ, আমি আর তখন পাশের চেয়ারে নেই।
কেন উঠলাম, বলা নেই কওয়া নেই প্রস্তুতি নেই–কেন সামনে এসে দাঁড়ালাম, কেন অভিনন্দন জানানোর লোভ সংবরণ করা গেল না, তার সঠিক বিশ্লেষণে অক্ষম। এই গান শোনার পর সামনে আসতে বা অভিনন্দন জানাতে মনে মনে হয়তো অনেকেই চেয়েছে। কিন্তু মনে মনে চাওয়া আর সরাসরি উঠে আসার মধ্যে তফাত আছে। শিল্পী যদি বয়েসকালের কোনো রমণী হয় ( যদিও এ-ক্ষেত্রে বছরে হিসেং ধরে বয়েসকালের বলা চলে না।) সাধারণত একটু বাড়তি প্রশংসা তার প্রাপ্যর মধ্যেই গণ্য। সেই রমণী যদি সুরূপা হয়, প্রশংসা তাহলে স্বতির আকার নিয়ে থাকে। আর সেই গুণবত সুরূপা রমণী যদি অফুরন্ত বিত্তের অধিকারিণী হয়, তাহলে তার আকর্ষণ বোধকরি এমনিই দুরতিক্রম্য। এমন কেন হয় আমার জানা নেই।
মহিলা ঈষৎ সচকিত। কিছু একটা তন্ময়তায় ছেদ পড়ল যেন। সোজা হয়ে বসে তাকালো।
সবিনয়ে বললাম, আপনার গান শোনার পর মনে হচ্ছে এখানে আসা সার্থক হল।
যশোমতী পাঠক বিব্রত মুখে হাসল একটু। অস্ফুট সৌজন্যে বলল, ধন্যবাদ….
কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি কি-রকম ধাক্কা খেলাম একটু। এরকম সাদা-মাটা প্রায় নির্লিপ্ত ভব্যতার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমার স্পষ্টই মনে হল, তিন দিন আগের সেই এক মিনিটের পরিচয় মহিলা ভুলে গেছে। অস্বাভাবিক কিছু নয়, কারণ দর্শক বা শ্রোতার আসনের অভ্যাগত আমি। তাছাড়া, আরও কতজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে সেদিন। সকলকে মনে করে না রাখতেও পারে। কিন্তু তা হলেও ত্রিপুরারির এত আগ্রহ করে আমাকে এখানে টেনে আনার সঙ্গে সুদর্শনার এই মাপা সৌজন্য ঠিক যেন মিলছে না। ত্রিপুরারি লিখেছিল, লেডি আমাকে প্রত্যহ তাগিদ দিচ্ছে তুমি আসছ কি না….। ফলে এ রকম ভুল আমার বিবেচনায় অন্তত খুব বাঞ্ছিত নয়। তাছাড়া ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালী দেখেও, আর আসা সার্থক হয়েছে শুনেও খেয়াল হবার কথা।