অবশ্য এটা নিতান্ত ব্যক্তিগত একটা বেখাপ্পা অনুভূতির ব্যাপার। বিশ্লেষণ করতে বললে অনেক রকম ব্যাখ্যা করে নিজের দুর্বলতা চাপা দেওয়া যেতে পারে। সে চেষ্টা করব না। সেই মুহূর্তে আমি মহিলার ঘোষবাবুর কথা ভাবিনি, নিজের কথাই ভেবেছি। আমার আসন শ্রোতাদের সঙ্গে। কিন্তু ওই ডায়াসের ওপরেও হতে পারত। কর্মকর্তাদের অনেক টানা-হেঁচড়া সত্ত্বেও কোনো শাখার ভার নিতে আমি রাজি হইনি। এখানে আসার সেটাই শর্ত ছিল–শ্রোতা হব, বক্তা নয়। সেজন্যে অবশ্য খেদ নেই এখনো, কিন্তু তবু মানুষের নিভৃতের কারিকুরি বড় বিচিত্র। মহিলার মুখে ঘোষবাবু, শুনেই কেমন মনে হল, আমার আসনটা আর একটু উঁচুতে, অর্থাৎ, ওই ডায়াসের ওপরে হলে মন্দ হত না।
তৃতীয় অধিবেশন-শেষে বিকেলের দিকে শঙ্কর সারাভাইয়ের দর্শন মিলল। ইতিমধ্যে ভদ্রলোকটির সম্বন্ধে কৌতূহল আরো একটু বেড়েছে। কেন, সেটা পরের প্রসঙ্গ। হলঘরে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে অনেককে ঘড় ফেরাতে দেখে বোঝা গেল গণ্যমান্য কেউ এলো। ত্রিপুরারি আমার পাজরে একটা খোঁচা দিয়ে বলল, শঙ্কর সারাভাই!
মাথা ঝাঁকিয়ে হাসিমুখে অনেকের অভিবাদনের জবাব দিতে দিতে এগিয়ে এলো। সৌম্যদর্শন লম্বা-চাওড়া মূর্তি। গায়ের রং কালোর দিক ঘেঁষা। মাথার ঝাকড়া চুলের দু’দিকে পাক ধরেছে। কপালের চামড়ায় গোটা দুই ভাঁজ পড়ে আছে। সেটা বয়সের নয়, প্রাজ্ঞ গাম্ভীর্যের নিদর্শন। অবশ্য, ত্রিপুরারির হিসেব ধরে ভদ্রলোকের বয়েস ঠিক পঁয়তাল্লিশ মনে হয় না, আরো কিছু বেশি মনে হয়। পরনে ঢোলা পাজামা, গায়ে লম্বা ঝুলের গরদের পাঞ্জাবি।
সব মিলিয়ে এক জোরালো পুরুষের মূর্তিই বটে।
কিন্তু এই মূর্তি পর্যবেক্ষণে আমি বেশি সময় অপচয় করিনি। আমার দু-চোখ ধাওয়া করেছে ও-পাশের দু’সারি আগের রমণীর মুখের দিকে। এই একজনের আবির্ভাবে সঙ্গে সঙ্গে ওই মুখের রং বদল দেখব এমন আশা অবশ্য করিনি। তবু, ত্রিপুরারির সকল বচন সত্য হলে দৃষ্টি আপনা থেকেই ওদিকে ছুটবে। না, ব্যতিক্রম কিছু চোখে পড়েনি। কৌতুক-মাধুর্য মেশা মুখখানা আরো একটু নির্লিপ্ত মনে হয়েছে শুধু। কে এলো না এলে সে সম্বন্ধে সচেতন নয় যেন। ….তবে এও নিজের কল্পনা হতে পারে।
ভদ্রলোকের অর্থাৎ শঙ্কর সারাভাইয়ের আজই সভার এই শেষ মাথায় হাজিরা দেবার পিছনে অন্য কোনো আকর্ষণ আছে কিনা, সে কথা পরে মনে হয়েছে। পরে, অর্থাৎ ঘন্টাখানেক পরে। আজই এই একজনের শুভাগমন হতে পারে সে-কথা ত্রিপুরারিও বলেনি, অর্থাৎ, তারও জানা ছিল না। হালকাগোছের সাহিত্য-প্রোগ্রাম ছিল সেদিন। তারপর গানের আসর। নিছক অনুমান কিনা জানি না, মনে হল এই গানের আসরই তাকে টেনেছে।
এই অনুষ্ঠানে প্রথমেই যে নামটি ঘোষণা করা হল, সেই নাম যশোমতীর। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় অভ্যাগতদের বিপুল করতালি। এ-রকম অভ্যর্থনা গানের খাতিরে কি গায়িকার খাতিরে পাশে ত্রিপুরারি থাকলে জিজ্ঞাসা করতাম হয়তো। কিন্তু ত্রিপুরারি পাশে নেই, শঙ্কর সারাভাইকে দেখেই সেই যে ‘আসছি’ বলে উঠে গেছে, এখনো ফেরেনি। এই পরিতোষণও চাকরির দায়ে কিনা জানা নেই।
মহিলা আসন ছেড়ে উঠল। জোরালো আলোয় মুখখানা আরো মিষ্টি, আরো একটু হাসি-হাসি দেখাচ্ছে। তাকে আপ্যায়ন করে নেবার জন্য দু’জন ভলান্টিয়ার দৌড়ে এলো। ঈষৎ মন্থর পায়ে যশোমতী ডায়াসে উঠে গেল। মানুষের মাথায় ঠাসা বিশাল হল ঘরটার মেজাজই বদলে গেছে যেন। অনেক সজাগ, অনেক সজীব। নিজের অগোচরে এবারে আমার দুচোখ শঙ্কর সারাভাইকে খুজছে। কিন্তু ভদ্রলোক যে কোন্ দিকের কোন্ সারিতে বসেছে ঠিক্ ঠাওর করা গেল না।
গান হল। শ্রোতাদের সরব সনির্বন্ধ অনুরোধে পর পর তিনটে পান।
একটা ঘণ্টা কোথা দিয়ে কেটে গেল টের পাইনি। আসরে বসে গান অজস্র শুনেছি। সেদিক থেকে একেবারে মোহিত হবার মতো কিছু শুনলাম, এমন বলব না। বিশেষ করে পাঁচ-মিশালি শ্রোতার আসরের গান খুব গভীর পর্যায়ের না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ক’দিন ধরে সাহিত্যের নানা ধারার ক্লান্তিকর জটিলতা বিস্তারের পর হঠাৎ যেন কানে ভারী মিষ্টি একটা স্পর্শ এসে লাগল। তাই, শুধু ভালো লাগল বলে অবিচারই করা হবে।
এত ভালো লাগবে আশা করিনি। কান পেতে শোনার মতই মিষ্টি পরিপুষ্ট কণ্ঠস্বর। সহজ, স্বচ্ছন্দ।
গানের সঙ্গে শিল্পীর একটা বিশেষ যোগ আছেই। অন্তত, আমার মত অ-গায়কদের সেই রকমই মনে হয়। সেই যোগটা শিল্পীর চেহারার কি পরিবেশন-মাধুর্যের–ঠিক জানিনে। প্রসঙ্গত কোনো এক বিখ্যাত মহিলা-শিল্পীর গানের আসরে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম একবার মনে পড়ে। গান শুনেছিলাম। সেই গানের তুলনা নেই, তা হয়তো সত্যি। কিন্তু তবু কেন যেন মন ভরেনি। তার কারণ সম্ভবত আগাগোড়া বেশির ভাগ চোখ বুজে শুনতে হয়েছিল বলে। না, সেই মহিলাও রূপসী না হোক একেবারে কুরূপা নয়। তা ছাড়া, গানের আসরে শিল্পীর যে রূপ সেটা আর এক বস্তু, জানি। তবু চোখের প্রসন্নতার বার বার ব্যাঘাত ঘটেছিল তার কারণ, শিল্পীর সঙ্গীত-তরঙ্গের প্রতিটি ঢেউ অস্থির অভিব্যক্তির আকারে শ্রোতার নিবিষ্টতা চঞ্চল করে তুলছিল। পুরুষ শিল্পীদের বেলায় এই ব্যাপারটা ততো বিসদৃশ ঠেকে না যত মেয়েদের বেলায় ঠেকে।