-হোম-মেড নেশা কি রকম?
—এখানে নেশার বস্তু দুর্লভ।
–আগ্রহ বোধ করার মতো কিছু রসদের ঘ্রাণ পাচ্ছি মনে হল। জিজ্ঞাসা করলাম, শঙ্কর সারাভাইয়ের বয়েস কত?
ভুরু কুঁচকে ত্রিপুরারি ভাল একটু। হিসেবে ভুল করা তার বীতি নয়। জবাব দিল, লেডির সঙ্গে আরো বছর পাঁচেক যোগ দাও।
—বিবাহিত?
চাপা কৌতুকে টসটস করে উঠল ত্রিপুরারির মুখ। সেই মুখ দিয়ে আধা কাব্য নিঃসৃত হল।-না, ওই এক রমণীবল্লভ।
এই প্রেমের সঠিক হদিস মিলল না। জিজ্ঞাসা করলাম তাদের মিলন-পর্বটি সমাধা হবে কবে-শ্মশান-যাত্রার আগে?
প্রসঙ্গ অন্য দিকে ঘুরে যেতে ত্রিপুরারির উৎসাহ বাড়ল। বলল, তাও হবে না, আবার হয়েও গেছে বলতে পারো। তোমরা সাহিত্যিক রাসকেলরা মিলন-পর্ব যাকে বলো, সে সম্বন্ধে সঠিক খবর দিতে পারব না। যা লেখো, পড়লে একা ঘরেও কান গরম হয়। মোট কথা, এ-ক্ষেত্রে আত্মার মিল, জাতের অমিল। সারাভাই বামুন নয়, যশোমতী পাঠক নিখাদ ব্রাহ্মণ-কন্যা….আজকালকার দিনে এখানে এরকম বাধা ঘোচেনি এমন নয়, কিন্তু ওদের ব্যাপারটা ঠিক সে রকম নয়।
ত্রিপুরারির প্রাথমিক রিপোর্ট অভিনব কিছু নয়, তবে মোটামুটি কৌতূহলোদ্দীপক। জিজ্ঞাসা করলাম, তা ব্যবসায় রেষারিষি খুব?
-খুব। আবার মিলও খুব। কোনো ব্যাপারে পরামর্শ দরকার হলে লেডি একমাত্র তার ওই লর্ডের শরণাপন্ন হয়। তা এতবড় কারবার চালাতে পরামর্শের তো হামেশাই দরকার। লর্ডটি সে ব্যাপারে উদার এবং মুক্ত-মস্তিষ্ক।
০২. মূল সভাপতি একজন
০২.
দুজনকেই দেখেছি। যশোমতী পাঠককে সম্মেলনের প্রতি দিনই। শঙ্কর সারাভাইকে একদিন। কিন্তু সেই একটা দিনের চিন্তা অজ্ঞাত অনেকগুলো দিনের মধ্যে প্রসারিত হতে চেয়েছে।
মূল সভাপতি একজন। শাখা সভাপতি এবং প্রধান অতিথির সংখ্যা অনেক। কিন্তু সভানেত্রীও একজন। যশোমতী পাঠক। অবশ্য সেটা স্থানীয় সম্পাদকের উদাত্ত ঘোষণায় জানা গেছে। সভানেত্রীর নীরব উপস্থিতি ছাড়া আর কোনো কাজ আছে বলেই মনে হয়নি আমার। বক্তৃতা করা দূরে থাক সভাপরিষদদের সঙ্গে উঁচু ডায়াসে গিয়েও বসেনি। সামনের সারির শ্রোতাদের এক পাশে একটা নির্দিষ্ট আসনে প্রত্যহ চুপচাপ বসে থাকতে দেখা গেছে তাকে। ত্রিপুরারি তার হয়ে সুপারিশ করেছে, বলেছে কর্মী যে যত প্রবল তার দুই ঠোঁট ততো বেশি সেলাই করা, বুঝলে? ওই মহিলা একদিন না এলে এমন জম-জমাট সভা-ঘর নীরস লাগত সকলের। এসে যখন ঢোকে, কেমন লাগে বল তো?
শেষের উক্তিতে আতিশয্য ছিল না। এই বিশাল হল-ঘরে মহিলার পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার কর্মকর্তাদের চোখে-মুখে এক ধরনের নীরব অথচ উৎফুল্ল তৎপরতা লক্ষ্য করেছি। আর সমবেত স্থানীয় ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলাদের সসম্ভ্রমে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেও দেখেছি। অভ্যস্ত সহজ সৌজন্যে এই শ্রদ্ধা গ্রহণ করে হাসিমুখে সহজোড়া চোখের ওপর দিয়ে এগিয়ে এসে সে মঞ্চের সামনের আসনটি গ্রহণ করেছে। সেই আসনও তার জন্য নির্দিষ্ট ছিল না। প্রথম দিন স্থানীয় উদ্যোক্তারা শশব্যন্তে তাকে মঞ্চের আসনে নিয়ে বসাতে চেয়েছিল। হাসিমুখে মহিলা শুধু একবার হাত নেড়ে দিয়ে সামনের আসনটিতে বসে পড়েছিল। তারপর রোজই সেই আসনে বসছে।
লক্ষ্য শুধু আমি নয়, সকল অতিথিবর্গই করেছে।
ত্রিপুরারি চল্লিশ বছর বয়েস বলেছিল মহিলার। আর তারপর পনেরোটা বছর হেঁটে নিতে বলেছিল তার থেকে। অতিশয়োক্তি করেনি। ….আর তার চেহারা প্রসঙ্গে আমার কৌতূহলের জবাবে বলেছিল, সামনে এসে দাঁড়ালে হিসেব-পত্র ভুল হবার মতো। সেই কাঠখোট্টা উপমা শুনে রূপসী বোঝা গিয়েছিল। সুখের ঘরে এই রূপের বাসা অভাবনীয় কিছু নয়। অর্থও রূপ বাড়ায়। সেই রূপ কিছুটা দেখা আছে। সেই রূপের থেকে চিত্ত বিচ্ছিন্ন করা কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আমার চোখে সব থেকে বেশি লোভনীয় যেটুকু মনে হয়েছে, সেটা মহিলার ঐশ্বর্যের ছটাও নয়, রূপের ছটাও নয়। সেটা রমণী-মুখের প্রায়-নিরাসক্ত কৌতুক-মাধুর্য। শুধু সেইটুকু লক্ষ্য করে দেখলে অ-শিল্পীরও শিল্পী হতে সাধ হতে পারে। সারাক্ষণ সেই কৌতুক যেন নিঃশব্দে একটু হাসি হয়ে চোখের পাতায় আর ঠোঁটের ফাঁকে টলমল করছে।
ত্রিপুরারির মুখে এত কথা শোনা না থাকলে আমি এভাবে দেখতুম কিনা জানি না। সমস্তক্ষণের মধ্যে কতবার চোখদুটো ওই মুখের দিকে ধাওয়া করেছে, পাশে বসেও চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট ত্রিপুরারি ঘোষ তা খেয়াল করেনি। খেয়াল করলে আমার লজ্জার কারণ হতে পারত। কারণ অভিযোগটা সকলরবে সে তার গৃহিণীর কাছে পেশ করত।
আলাপ ঠিক নয়, তবে প্রথম দিনের অধিবেশনেই পরিচয় হয়েছিল মহিলার সঙ্গে। উদ্যোক্তাদের মারফত নিতান্ত আনুষ্ঠানিক পরিচয়। মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত জোড় করে অভিবাদন গ্রহণ করেছে এবং জানিয়েছে। অন্যদের বেলায় এটুকুতেই শেষ হয়েছে, আমাকে শুধু বলেছে, আপনার কথা ঘোষবাবুর মুখে শুনেছি।
বলা বাহুল্য, আমি খুব কৃতার্থ বোধ করিনি। ত্রিপুরারিকে ঘোষবাবু না বলে মিস্টার ঘোষ বললে কানে একটু অন্যরকম লাগত কিনা বলতে পারি না। অস্বস্তিকর অনুভূতিটা গোপন করা সহজ হচ্ছিল না খুব। ত্রিপুরারি আমার বন্ধু। আর ঘোষবাবু এর বেতনভুক। কর্মচারী। তুলনা দিতে হলে কুবের-নন্দিনীর দ্বাররক্ষী উপমাটাই মনে আসে। বন্ধুকে ভালোবাসি, কিন্তু ঘোষবাবুর মতো অনুগ্রহভাজন হতে চাই না।