.
কিন্তু কটন চেম্বারের পঁচিশ হাজার টাকার প্রাইজ শঙ্কর সারাভাই পায় নি। পাবেই যে সেটা স্থিরনিশ্চিত জেনেও সমস্ত একাগ্রতা দিয়েই শাড়িটা শেষ করেছিল। আর মনে মনে আশা করেছিল, সঠিক বিচার হোক না হোক, মানের দিক থেকেও সে খুব পিছিয়ে পড়ে নি।
কিন্তু কাগজে যার শাড়ি প্রথম হয়েছে তার নাম দেখে সে অবাক হয়েছে। সেই নাম শঙ্কর সারভাইয়ের নয়। অপরিচিত একজনের। তার নাম দ্বিতীয়। সে শুধু সার্টিফিকেট পাবে।
বার বার পড়েছে খবরটা শঙ্কর সারাভাই। আর, শুধু হেসেছে নিজের মনে। এমন প্রসন্ন হাসি অনেক দিন তার মুখে দেখা যায় নি। কাগজে খবরটা দেখার পরেই সে যেন নিশ্চিত জেনেছে, কটন চেম্বারের পুরস্কারের বিচার এই প্রথম যথাযোগ্য হয়েছে। মান বিচারে এতটুকু কারচুপি হয় নি।
যশোমতী পাঠক হতে দেয় নি।
তাই সাগ্রহে সার্টিফিকেট নিতেই উৎসবে এসেছে শঙ্কর সারাভাই। এত আগ্রহ নিয়ে আসার আরো কারণ আছে। অন্যান্যবার পুরস্কার দিয়েছে মিসেস চন্দ্রশেখর পাঠক, কিন্তু কাগজের ঘোষণায় দেখা গেল এবারে পুরস্কার দেবে চেম্বার-প্রেসিডেন্টের কন্যা যশোমতী পাঠক।
প্রতিবারের মতোই সেই সাড়ম্বর অনুষ্ঠান। সাজের বাহারে ঝলমল করছে চেম্বারের সামনের বিরাট আঙিনা। প্যাণ্ডেলের আলোর বন্যা দিনের আলোকে হার মানিয়েছে। গোটা দেশের মানী জনের সমাবেশ।
এর মধ্যে প্রেসিডেন্টের পাশে পুরস্কার-দাত্রীকে দেখে অবাকই হয়েছে বহু বিশিষ্ট মেয়ে-পুরুষ। না, ঠিক যশোমতীকে দেখে নয়। এমন সমাবেশে তার সাজসজ্জা দেখে। বাড়িতে অবাক হয়েছিল যশোমতীর বাবা-মা। এখানে সকলে।
কাছাকাছি এক সারিতে বসে নিষ্পলক তার দিকে চেয়ে ছিল শঙ্কর সারাভাই। যশোমতীর গায়ে শুধু সেই গয়না, যে ক’টি গয়না পরে সে একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর তার পরনে সেই শাড়ি দুটোর একটা, যা শঙ্কর নিজের হাতে তাকে তৈরি করে দিয়েছিল। আর, যশোমতী ডায়াসে ওঠার সময় শঙ্করের বিমূঢ় দৃষ্টিটা তার পায়ের দিকেও পড়েছিল একবার। পায়ে সেই স্যাণ্ডেলজোড়া–যশোমতীকে তার ঘর-ছাড়া করার দিন যেটা সে তাড়াহুড়ো করে কিনে এনে দিয়েছিল।
প্রাথমিক বক্তৃতা আর অনুষ্ঠানাদির পর প্রথম পুরস্কৃতের নাম ঘোষণা হতে সেই ভদ্রলোক উঠে এগিয়ে এলো। যশোমতী বাড়িয়ে হাসিমুখে পঁচিশ হাজার টাকার চেক সমর্পণ করল তার হাতে।
দ্বিতীয় নাম ঘোষণা হল। শঙ্কর সারাভাই–
যশোমতী তখনো জানে না সে এসেছে কিনা। শুধু আশা করছিল আসবে। এত ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়া কঠিন। কিন্তু আগেও তার দুচোখ থেকে থেকে কাকে খুঁজেছিল, শঙ্কর সারাভাই জানে। সে উঠল। এগলো।
সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে যশোমতী দাঁড়িয়ে আছে।
শঙ্কর সারাভাই এগিয়ে গেল। দেখছে দু’জনে দু’জনকে।
সার্টিফিকেটটা হাতে দেবার আগে সমাগত অভ্যাগতদের উদ্দেশে যশোমতী কয়েকটি মাত্র কথা বলল। বলল, আজ প্রথম পুরস্কার যিনি পেলেন তিনি অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু প্রথম পুরস্কার যিনি পেলেন না, তাঁরও চেষ্টার পুরুষকার একদিন ঠিক এই সার্থকতায় সফল হবে, তাতে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। তার সেই চেষ্টার সঙ্গে আমার সমস্ত অন্তর যুক্ত থাকল।
চারদিক থেকে বিপুল করতালি।
সার্টিফিকেট নেবার জন্য দু’হাত বাড়াল শঙ্কর সারাভাই। দু’হাতে সার্টিফিকেট নিয়ে যশোমতী সার্টিফিকেটসহ নিজের হাত দুটিই রাখল তার হাতের ওপর। কে দেখছে যশোমতী জানে না। কে দেখছে শঙ্কর সারাভাই জানে না।
….কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র। কয়েকটি নিমেষের নিষ্পলক দৃষ্টি বিনিময়।
.
১১.
আসার সময় সাবরমতী দেখেছিলাম, আর, যশোমতীকে দেখছিলাম।
স্টেশনে অতিথি-বিদায়ের ঘটাটা মন্দ হল না। আমাকে গাড়িতে তুলে দেবার জন্য যশোমতী পাঠক এসেছে, শঙ্কর সারাভাই এসেছে, ত্রিপুরারি এসেছে, এখনকার নতুন বন্ধুরাও দু-পাঁচ জন এসেছে।
যশোমতীকে কিছু বলার ফাঁক খুজছিলাম আমি। ফাঁক পেলাম। বললাম, আপনার ট্রাজেডি পছন্দ নয় বলেছিলেন, এবারে লিখি যদি কিছু, সেটা কমেডিই হোক। কি বলেন?
শুনে হঠাৎ যেন এক প্রস্থ থতমত খেয়ে উঠল যশোমতী। তার পরেই সমস্ত মুখে সিদুরের আভা। সবেগে মাথা নেড়ে বলে উঠল, না, কক্ষনো না!
কাছেই ছিল শঙ্কর সারাভাই। সকৌতুকে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞাসা করল, কি হল? শুনলাম না–
তক্ষুনি চোখ পাকালো যশোমতী, চাপা গলায় বলল, সবেতে নাক গলানোর কি দরকার, ওদিকে যাও না–
হেসে উঠল সঙ্গে সঙ্গে।
ট্রেন ছেড়ে দিল। সাবরমতী থেকে দূরে চললাম। সাবরমতীর নীলাভ জলের সঙ্গে কতটা ট্রাজেডির যোগ আর কতটা কমেডির, আমার জানা নেই। জানলায় ঝুঁকে যশোমতীকে দেখছি তখনো। হাসিমুখে রুমাল নাড়ছে। আর আমার মনে হচ্ছে, ট্রাজেডি হোক কমেডি হোক–দুই নিয়েই সাবরমতী পরিপূর্ণ।