–ফেরত দিয়ে গেছেন আমাকে বলো নি তো?
–ওকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে আবার সেটা দিয়ে দেব ভেবেই বলি নি। ওর মেসোর সঙ্গে সেই রকমই কথা হল, তাছাড়া আরো কিছু করা যায় কিনা ওর জন্যে ভাবছিলাম….সেই জন্যেই তো আজ ডেকে পাঠিয়েছিলাম।
–চেক আজ দিতে পারলে?
বিব্রত মুখে চন্দ্রশেখরবাবু মাথা নাড়ল। পারেনি।
–আর, আর-কিছুও করতে পারলে?
নিজের চিন্তাধারার ব্যতিক্রম দেখে অভ্যস্ত নয় চন্দ্রশেখর পাঠক। তাই ঈষৎ বিরক্ত মুখে জবাব দিল, না, ছেলেটাকে খুব বুদ্ধিমান মনে হল না, কথাই শোনে না ভালো করে।
আরো একটু দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখল যশোমতী। তার রাগ হবে কি, এক উৎকট আনন্দে বুকের ভিতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। এ আনন্দ যেন ধরে রাখা যাচ্ছে না। জীবনে এমন আনন্দ এই যেন প্রথমে।
.
১০.
দেব-উঠি-আগিয়ারস্।
সাবরমতীর মেলা। দেবতা উঠবেন। লোকে লোকারণ্য। এরই মধ্যে যশোমতী একটু ফাঁক খুঁজে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। সঙ্গে কেউ নেই আর। বাড়ির কেউ জানেও না। একা এসেছে। অপেক্ষা করছে।
চিঠির জবাব পায় নি যশোমতী। ছোট্ট দু’লাইন চিঠি লিখেছিল দিনকতক আগে। লিখেছিল, এর পরেও দেখা হবে আমি আশা করছি। দেবোত্থান একাদশীতে সাবরমতীতে আসার কথা ছিল। পুজো দেবার কথা ছিল। আমি অপেক্ষা করব।
অপেক্ষা করছে। নিশ্চিত জানে সে আসবে। দেখা হবে।
এলো। দেখা হল।
চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। গম্ভীর। কিন্তু সেও পুরুষের ক্লান্তি। পুরুষের গাম্ভীর্য।
আশ্চর্য, সমুদ্র-পরিমাণ কান্না চেপেও যশোমতী হাসতে পারছে। হাসছে। একটু কাছে এগিয়ে এলো। চোখে চোখ রেখে বলল, অপেক্ষা করছি।
শঙ্কর সারাভাই জবাব দিল না। চুপচাপ চেয়ে আছে।
যশোমতীর তাড়ায় নদীতে নেমে চান করতে হল শঙ্করকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যশোমতী দেখতে লাগল। নদীর জলে অগণিত মাথার মধ্যে শুধু একজনকেই দেখছে সে।
চানের পর যশোমতী পুজো দেবার কথা বলল।
শঙ্কর সারাভাই জিজ্ঞাসা করল, কি জন্যে পুজো?
–যে জন্যে কথা ছিল। তেমনি চোখে চোখ রেখেই কথা বলছে যশোমতী। হাসছে। বলল, সত্যিকারের পুরুষমানুষ কথা দিয়ে কথার খেলাপ করে না–বিশেষ করে অবলা রমণীকে কথা দিলে। আজই বিকেলে ফিরে গিয়ে কটন চেম্বারের এগজিবিশনের শাড়িতে হাত দেবার কথা ছিল।
শঙ্করের মুখখানা গম্ভীর, কিন্তু ঠোঁটের ফাঁকে হাসির রেখা উঁকি দিতে চাইল একটু। বলল, কথা ছিল, কিন্তু এরপর আপনাদের অনুকম্পা আমার খুব ভালো লাগবে না।
যশোমতী গম্ভীর।–আপনাদের বলতে একজন তো আমি, আর সব কারা?
মুখের হাসি আরো একটু স্পষ্ট হল শঙ্করের। বলল, আপনার বাবা, আপনার মা
তাদের অনুকম্পা তো কত নিয়েছেন আপনি। আপনি চাইলে ওই কটু চেম্বারের পঁচিশ হাজার টাকা ছেড়ে আমি আপনাকে দু’পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে পারি। আপনিও চাইবেন না, আমিও এক পয়সা দেব না। অনুকম্পা বলছেন কেন, এখন আমার শিক্ষা হয় নি বলতে চান?
শঙ্কর সারাভাই পুজো দিল। যশোমতী নীরবে অপেক্ষা করল ততক্ষণ। পুজো শেষ হতে যশোমতী জিজ্ঞাসা করল, এখন কি করবেন?
বাড়ি যাব।
বাড়ি গিয়ে?
হেসেই শঙ্কর সারাভাই জবাব দিল, আপনার হুকুম পালন করব, মানে কারখানায় গিয়ে ঢুকব–
খাওয়া দাওয়া?
–তার পরে।
–কত পরে?
শঙ্কর সারাভাইয়ের টানা বিষণ্ণ দুই চোখ আস্তে আস্তে তার মুখের উপর স্থির হল।হঠাৎ আমার ওপর আপনার এই অনুকম্পা কেন?
অনুকম্পা!
অস্ফুট কণ্ঠস্বরে, চোখে মুখে এক অব্যক্ত বেদনার ছায়া দেখল শঙ্কর সারাভাই। বলল, আপনিও সকাল থেকে না খেয়ে আছেন তো?
সেটা অনুকম্পা?
শঙ্কর সারাভাই চুপচাপ চেয়ে রইল খানিক। কি দেখল বা কি বুঝল সে-ই জানে। হাসল একটু।–আচ্ছা, আর বলব না। বাড়ি গিয়ে খেয়ে নেবেন। মিথ্যে কষ্ট পাবেন না।
যশোমতীর দুই ঠোঁটের ফাঁকে এবারে হাসির নাভাস একটু। জবাব দিল, কষ্ট পাওয়া কপালে থাকলে আর খাবো কি করে। বেশি কষ্ট যদি না দিতে চান তাহলে শুভ কাজ শুরু করা হলেই আগে খেয়ে নেবেন।
অর্থাৎ, তার আগে পর্যন্ত তারও মুখে আহার রুচবে না। শঙ্কর সারাভাই বিব্রত বোধ করল। কিন্তু এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে মন সরল না। এই প্রাপ্তিটুকু নিঃশব্দে অনুভব করার মতোই শুধু। বলল, আচ্ছা।
কথা দিচ্ছেন?
হ্যা।
আর দেরি করে কাজ নেই তাহলে, চলুন আপনাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তারপর বাড়ি যাব।
এবারেও বাধা দিতে পারল না শঙ্কর সারাভাই। ট্যাক্সি করে দু’জনে স্টেশনে এলো। গাড়ি আড়াল না হওয়া পর্যন্ত হাসি মুখে যশোমতী স্টেশনে দাঁড়িয়েই থাকল।
কথা রেখেছে। বাড়ি ফিরে শঙ্কর সারাভাই কথা রেখেছে। বিহারীকে নিয়ে সোজা ফ্যাক্টরি ঘরে ঢুকে শুভ কাজে হাত দিয়েছে। একটু বাদে বিহারীর বিস্মিত চোখের ওপরেই কাজ বন্ধ করে খেতে গেছে।
তারপর ক’দিন তার এই কাজের তন্ময়তা লক্ষ্য করে করে দিদির খটকা লাগল কেমন। জিজ্ঞাসা করল, নতুন অর্ডার-টর্ডার পেলি নাকি কিছু?
শঙ্কর সারাভাই হাসি মুখেই দিদিকে জানিয়েছে ব্যাপারটা। তারপর বলেছে, পঁচিশ হাজার টাকা এবারে ঘরে আসছে, এটা ধরে নিতে পারো।
দিদি চেয়ে আছে। ভাইয়ের মুখের হাসি দেখছে। ওই হাসির আড়ালে পঁচিশ হাজার টাকা যে আসছে সেই আনন্দের ছিটে ফোঁটাও চোখে পড়ল না।
দিদি জিজ্ঞাসা করল, এগজিবিশনে শাড়ি পাঠাচ্ছিস কেন?
শঙ্কর সারাভাই আবারও হাসল শুধু একটু, জবাব দিল না।