-সত্যি?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে প্রাণ বেঁচেছে ওই শর্ট-কাট বার করে। প্রথম, মাঝের আর শেষের–তিন তিরিক্কে ওই ন’পাতা। তাও কি হয়। এক একটা অ্যাকাউন্টস্ মেলাতে গিয়ে কতবার পর পর তিন রাত চার রাত চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেছে–সেই ঘুম পোড়া চোখের সামনে যেই তোমাদের ওই ছাইভস্ম গল্পের বই খোল, অমনি কে যেন সাড়াশি দিয়ে ধরে চোখের পাতা টেনে নামিয়ে দেয়। শেষে ওই শর্ট-কাট বার করে বাঁচোয়া। দিনে তিন পাতা করে তিন দিনে ন’পাতা-একখানা বই শেষ। চরিত্রের নাম জানা গেল, কে কোন্ হাওয়ায় ভাসছে একটু-আধটু বোঝা গেল, আর শেষ ওলটালে বিচ্ছেদ কি মিলন সে তত দয়া করে তোমরা জানাবেই। ব্যস, আলোচনায় একটু-আধটু মুখ নাড়ার পক্ষে ওটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু তাও কি ফ্যাসাদ কম! তিনটে বই শেষ করতে না করতে সব মিলে-মিশে জগাখিচুড়ি, –এই বইয়ের নায়ক ওই বইয়ের নায়কের ঘাড়ে চাপল, এর ঘটনা ওর কাঁধে। এক নায়িকার মিলন আর এক নায়িকার বিরহের সঙ্গে ঘুলিয়ে গেল–রাবিশ! গোড়া থেকে একটা চার্ট করে পড়লে হয়তো কিছুটা মনে রাখা সম্ভব।….কি বিপাকে না পড়েছিলাম সেদিন। তোমার কোন্ উপন্যাসের কি এক চরিত্র মনে ধরেছে আমাদের লেডির, প্রশংসা কচ্ছিল–চোখ কান বুজে আমিও দু’দশ কথা জুড়ে দিলাম, যেন আমার পরামর্শ নিয়েই তুমি লিখেছ। তারপর দেখি ভদ্রমহিলা হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে আছে। তক্ষুনি বুঝলাম মিসফায়ার হয়ে গেছে। মুখ টিপে হেসে লেডি বলল, আপনার সব ঘুলিয়ে গেছে, কার সঙ্গে কি জুড়ছেন ঠিক নেই।
আমার শ্রোতার ভূমিকা। শুনতে ভালো লাগছিল। কিন্তু ত্রিপুরারি আবার বাড়িয়ে বলছে কিনা সেই খটকা লাগল। জিজ্ঞাসা করলাম, এ-সব বই তো অনুবাদ হয়নি, উনি বাংলা পড়তে পারেন নাকি?
-বাংলা এখানে অনেকেই লিখতে পড়তে পারে–আমাদের লেডি বাংলায় ভাবতে পর্যন্ত পারে। তার লাইব্রেরি বাংলা বইয়ের সমুদ্র একখানা। দেখলে তোমার তাক লেগে যাবে। কলকাতা থেকে বই আসে না এমন মাস যায় না।
অবাক হবারই কথা। কাপড়ের কলের সঙ্গে সাহিত্য বস্তুটার কতটা মেশা সম্ভব–সেই সংশয়। বললাম, ওঁর তো মস্ত কটন্ মিল শুনেছি।
-হ্যাঁ। বিগেস্ট।
–উনিই চালান?
–সব তার নখদর্পণে।
লেডির লর্ড কি করেন?
মুচকি হেসে জবাব দিল, আইনত লর্ড নেই।
তেমন প্রাঞ্জল ঠেকল না কানে। জিজ্ঞাসা করলাম, ছেলে পুলে কি?
তুমি একটি গণ্ডমূর্খ। ছেলে-পুলে থাকতে হলে একটি স্বামীর দরকার হয়।
আমি অপ্রস্তুত।–কেন, বিধবা নন?
-না। অধবা।
শোনামাত্র যে অনুভূতিটা প্রবল হল, তার নাম কৌতূহল। এই কাহিনীর সূত্রপাত তখনি ঘটে গেল কিনা জানি না। ত্রিপুরারির গাম্ভীর্যটুকু খুব অচপল মনে হল না।
-বয়েস কত?
–গোটা চল্লিশ হতে পারে।
সম্ভাব্য কাহিনীটা একটু নিষ্প্রভ হবার দাখিল। তবু বললাম, একেবারে হতাশ হবার মতো নয়, চেহারা স্বাস্থ্য-টাস্থ্য কেমন?
ত্রিপুরারি ঘুরে বসল।–কি মতলব?
–কিছু না। কেমন?
ত্রিপুরারি কাব্য করতে জানে না। তবু যা বলল, খুজলে একটু কাব্যের ছোঁয়া মিলতে পারে। সামনে এসে দাঁড়ালে হিসেব-পত্র ভুল হবার মতো। দেখলে চল্লিশ বছর বয়সের থেকে গোটা পনেরো বছর অন্তত ঝেটিয়ে বাদ দিতে ইচ্ছে করবে। তোমাদের তো করবেই, চল্লিশ নিয়ে কবে আর কারবার করে তোমর-ও বয়েসটা কেবল মাসি পিসির ঘাড়ে চাপিয়ে বেড়াও।
অ্যাকাউন্টেন্ট যেন আমিই, বললাম, চল্লিশের হিসেব নিয়ে এগনোর ব্যাপারেও অনভ্যস্ত নই খুব। মোট কথা তুমি তাহলে লেডিকে চল্লিশ মাইনাস পনের ইজ, ইকোয়াল টু পঁচিশের চোখে দেখো?
–আমি? আমি তাকে দেখলে চোখে শুধু সর্ষেফুল দেখি।
–তোমার সঙ্গে ভাব-সাব কেমন?
জবাব দিল, ভাব-সাব বলতে সুনজর খুব। এতবড় ব্যবসার চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট একজন বাঙালী হবে এটা কেউ চায়নি। সতেজনে সতের রকম পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু আগের বুড়ো চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট রিটায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে কাউকে একটি কথাও জিজ্ঞাসা না করে লেডি যা করা উচিত তাই করলে, চোখ-কান বুজে সরাসরি আমাকে তার জায়গায় বসিয়ে দিলে।
গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করলাম, একেবারে বসিয়ে দিলে, না কিছু বাকি আছে?
খটকা লাগল, কিন্তু ঠিক বুঝে উঠল না। বোকার মতো জিজ্ঞাসা করল, কি বললে?
বললাম, তোমার আশা কি? বক্তব্য আরো প্রাঞ্জল না করলে ওর হিসেবী মাথায় ঢুকবে না।–ঘরে তো সেই কবে একটিকে এনে বসে আছ–তার মারফত আরো কটি এসেছে খবর রাখিনে–ছেলে পুলে কি তোমার, তিনটে না চারটে?
হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক, তারপর আস্তে আস্তে বোধগম্য হল যেন। ড্রাইভার বাংলা বোঝে না, তাও সচকিত। মুখখানা দেখার মতই হল তারপর। কোনো দেবী অথবা দেবী সদৃশাকে ভুল রসিকতার মধ্যে টেনে আনতে দেখলে ভক্ত যেমন বিচলিত হয়, ত্রিপুরারির মুখের সেই অবস্থা। চুপচাপ খানিক চেয়ে থেকে মন্তব্য করল, তুমি একটা রাসকেল! হেসে ফেলল।একটু আগে বল’ছাম, আইনত লেডির কোন লর্ড নেই, সেটা কানে গেছে?
-গেছে।
-কিন্তু আইনের বাইরে একজন আছে। সে-খবর রাখে না ছেলে বুড়ো মেয়ে-পুরুষের মধ্যে এমন একজনও পাবে না। জেনেও সকলে শ্রদ্ধাই করে তাদের। চাপা রসিকতায় বলার ধরন তরল হয়ে আসছে ত্রিপুরারির।
–লর্ডটি কে?
–শঙ্কর সারাভাই–সে-ও মস্ত কটন মিলের মালিক, ব্যবসায়ে আমাদের লেডির সঙ্গে কী কপিটিশন। সেই রেষারেষি দেখলে তুমি ভাবও একজন আর একজনকে ডোবাবার ফিকিরে আছে কেবল। এই দুদিন আগেও লেডি তার মিলের একজন ভালো মেসিনম্যান ভাঙিয়ে আনতে পেরে মহা খুশি। পরে জানা গেল সেই ভাটিয়া ভদ্রলোক দিনের বেলাতেও হোম-মেড, নেশা করত বলে শঙ্কর সারাভাই তিনবার ওয়ানিং দিয়ে তাকে বরখাস্ত করেছে।