ওদিকে স্ত্রীও সহায়তা করল একটু। মেয়ের উদ্দেশে বার দুই বলল, গরীবের ছেলে, তোকে আদর-যত্ন করে রেখেছিল–খুব ভালো মনে হল।….কিন্তু অব্রাহ্মণের বাড়িতে এতদিন ভাত-টাত খেলি ভাবলেই কেমন খারাপ লাগে।
দ্বিতীয়বার এই কথা শুনে মেয়ে চটেই গেল।–প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না কি করতে হবে বলো?
মা আর ঘাঁটাতে সাহস করল না। সন্ধ্যার পর বাবা এসে বলল, ওই শঙ্কর ছেলেটিকে কাল একবার দেখা করতে বললাম, দেখি যদি কিছু করতে পারি।
যশোমতী চাপা রাগে ফুঁসে উঠল তৎক্ষণাৎ।– কেন, টাকা তো পেয়েছে, আবার কি করতে হবে?
চন্দ্রশেখরের আশা, ছেলেটা যদি আরো বড় টোপ গেলে। তাই টাকাটা ফেরত দেবার কথাটা বলি-বলি করেও বলল না। কিছু গ্রহণ না করার বৈশিষ্ট্যটা মেয়ের কাছে নিষ্প্রভ করে দিতেই চায় সে।
পরদিন বা অফিসে চলে যাবার পরেও যশোমতী গুম হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ কি মনে পড়তে উঠে পড়ল। বেরুবে। আধ-ঘণ্টার মধ্যেই প্রকাণ্ড ঝকঝকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েই পড়ল। বড় একটা স্টেশনারি দোকান থেকে অনেক দাম দিয়ে ছোট ছেলেদের একটা মোটর আর সাইকেল কিনল। সঙ্গে আরো টাকা আছে, বিহারীকে দেবে। বিহারীর দেশের বাড়ি-ঘরের সমস্যার কথা শুনে তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসেছিল। তারপর টানা মোটরেই সেই পরিচিত গ্রামে চলে এলো।
বাড়ির দোরের আঙিনায় হঠাৎ অমন একটা গাড়ি এসে থামতে দেখে দিদি অবাক হয়েছিল। ছেলে চেঁচামেচি করে উঠল, মাসি এসেছে।
গাড়ি থেকে নামল যশোমতী। চোখে জল আসতে চাইছে কেন জানে না। ভিতরে ভিতরে জ্বলে যাচ্ছে আবার। তাকে দেখে দিদির মুখে কথা সরল না হঠাৎ। ওদিকে ড্রাইভার রাজুর মোটর আর সাইকেল নামাতে সে আনন্দে লাফালাফি নাচানাচি শুরু করে দিল।
দিদি কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। ঘরে এনে বসালো তাকে। ভাইকে অপমান করেছে, দেখা করে নি, অথচ নিজেই বাড়ি বয়ে চলে এলো।
বলল, শঙ্কর মেসোমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছে, তিনি বিশেষ করে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
যশোমতী হাসিমুখেই বলে বসল, তিনি আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেছেন, বিশেষ করে বাবাই ডেকে পাঠিয়েছেন।
দিদি জানে। তবু মেসোমশাই ও-ভাবে অনুরোধ না করলে ভাই যে যেত না, সেটা আর বলল না। যশোমতী রাজুর সঙ্গে খেলা শুরু করে দিল। তাকে তার মোটর চালাতে শেখাল, সাইকেল চড়তে সাহায্য করল। তারপর ফাঁক মতো বিহারীকে ধরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কারখানার চেহারা কতখানি বদলানো হয়েছে সেই কৌতূহলও কম নয়।
কিন্তু দিদিও এলো সঙ্গে সঙ্গে।
ফ্যাক্টরির ভিতরে ঢুকে যশোমতী অবাক একটু। আরো যেন ছন্নছাড়া চেহারা হয়েছে ভিতরটা, ক’দিনের মধ্যে কিছু কাজ হয়েছে কিনা সন্দেহ।
বলেই ফেলল, সেই রকমই দেখি আছে, নতুন কিছুই তো হয় নি এখন পর্যন্ত–
দিদি ঠাণ্ডা জবাব দিল, কোত্থেকে আর হবে বলো, ক’দিন তো বই আছে।
সঙ্গে সঙ্গে ঈষৎ তীক্ষ্ণকণ্ঠে যশোমতী বলে উঠল, কেন? টাকা হাতে পেয়ে আর খরচ করতে ইচ্ছে করছে না?
দিদি বিমূঢ় প্রথম। তারপর বলল, তোমার দেওয়া চেক তো তোমার বাবার হাতে শঙ্কর ফেরত দিয়ে এসেছে, তোমার বাবা বলেন নি?
সেই মুহূর্তে কার সঙ্গে কথা বলছে তাও যেন ভুলে গেল যশোমতী। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, কক্ষনো না। ব্যাঙ্কের লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল টাকা দেবে কিনা, আমি নিজে দিতে বলে দিয়েছি।
দিদি যেন হকচকিয়ে চেয়ে রইল কয়েক নিমেষ। তারপর আত্মস্থ হল। সংযত হবার চেষ্টায় মুখ ঈষৎ লাল। বলল, তোমরা বড়লোক, তোমাদের টাকার কোন লেখাজোখা নেই শুনেছি। এই জন্যেই বোধহয় টাকার জন্যে গরীবেরা অনায়াসে মিথ্যে কথা বলতে পারে বলে ভাব তোমরা।
এবারে যশোমতীর বিস্ময়ের অন্ত নেই। ঘাবড়েই গেল সে। দিদি ডাকল, বিহারী, এদিকে আয়–
সোজা বাড়ির উঠোনে এসে আঁড়াল সে। পিছনে বিহারী আর সেই সঙ্গে যশোমতীও।
-ওই মোটর আর সাইকেল গাড়িতে তুলে দে। যশোমতীর দিকে ফিল, শঙ্কর এসে দেখলে রাগ করবে, তাছাড়া গরীবের ছেলের এসব লোভ থাকলে অসুবিধে–
যশোমতী কাঠ। পাঁচ বছরের রাজুও হতভম্ব হঠাৎ। ওইটুকু ছেলের মুখের আনন্দের আলো নিভেছে। অথচ মায়ের মুখের দিকে চেয়ে সাহস করে একটু প্রতিবাদও করতে পারছে না। বিমূঢ় বিহারী সত্যিই ওগুলো নেবার জন্যে হাত বাড়াতে ছেলেটার দিকে চেয়ে বুকের ভিতরটা ফেটে যাবার উপক্রম যশোমতীর।
হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে দিদির পায়ের কাছে বসে পড়ল যশোমতী। তার পা দুটো জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
দিদি সরবার অবকাশ পেল না। আঁতকেই উঠল।–ছি ছি বামুনের মেয়ে। তাড়াতাড়ি হাত ধরে টেনে তুলল তাকে। তারপর চেয়ে রইল। মুখখানা শান্ত কমনীয় হয়ে উঠল। বিহারীকে বলল, থাক তুলতে হবে না।
বাড়ি ফিরে যশোমতী হাতের প্যাকেটটা প্রথমে যত্ন করে তুলে রাখল। আসার সময় এটা সে দিদির কাছ থেকে চেয়ে এনেছে। ওতে আছে দুটো শাড়ি যে শাড়ি দুটো শঙ্কর সারাভাই নিজের হাতে তৈরি করে তাকে দিয়েছিল। তারপরেও নিজেকে সংযত করার জন্যেই ঘরে বসে রইল খানিক। তারপর বাবার কাছে এলো।
খুব ঠাণ্ডা মুখে জিজ্ঞাসা করল, শঙ্করবাবু সেই পঞ্চাশ হাজার টাকার চেকটা তোমার কাছে ফেরত দিয়ে গেছেন?
মেয়ের প্রশ্নের ধরনটা ভাল ঠেকল না কানে, চন্দ্রশেখর পাঠক এই প্রথম যেন পরিবারের কারো কাছে বিচলিত বোধ করল একটু। বলল হ্যাঁ, ছেলেটা কেমন যেন….