আশ্চর্য, সোমবারেও চেক ভাঙাতে যাওয়া হল না শঙ্কর সারাভাইয়ের। হল না বলে নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত। না যাওয়ার কোন কারণ ছিল না। হঠাৎ কেমন মনে হল, আজ না ভাঙিয়ে কাল ভাঙালেই বা ক্ষতি কি।
কিন্তু ওই একদিনে মনের কোণের সেই অজ্ঞাত অস্বতিটা যেন চারগুণ স্পষ্ট হয়ে ছেকে ধরতে লাগল তাকে। যশোমতীকে নিয়ে ফেরার সময়ে ট্রেনের দৃশ্যটা মনে পড়ল। হ্যাঁ, শঙ্কর জানে যশোমতীর সেই দৃষ্টিতে শুধু ঘৃণা ছাড়া আর কিছু ছিল না।….আর তারপর সেই চেক লিখে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার দৃশ্যটা চোখে ভাসতেই বুকের ভিতরে মোচড় পাড়তে লাগল। যেভাবে দিয়েছে–কোনো ভিখিরিকেও কেউ ও-ভাবে কিছু দেয় না।
সমস্ত রাত জেগে ছটফট করল শঙ্কর সারাভাই। নিজের সঙ্গেই ক্রমাগত যুঝছে সে। ভাবীকালের ফ্যাক্টরির চিত্রটা বিরাট করে দেখতে চেষ্টা করছে। কিন্তু তারপরেই যা আছে বর্তমানে, সেটাই যেন হাঁ করে গিলতে আসছে তাকে। না, শঙ্কর এই দারিদ্র্য আর সহ্য করতে পারবে না।
পরদিন সময়মতোই ট্রেন ধরল। সময় মতোই ব্যাঙ্কে পৌঁছুল। কিন্তু কি যে হল একমুহূর্তে কে জানে। কি এক দুর্ভর যাতনা আর যেন সে সহ্য করে উঠতে পারছে না।
চেক পকেটে নিয়েই সে সোজা চলে এলো চন্দ্রশেখরের বাড়িতে। কর্তা বাড়ি নেই। মেয়েকে ডেকে পাঠালো।
কিন্তু মেয়ে নিজেই তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে। যশোমতী আনলে লাফিয়ে উঠেছিল প্রায়। পরক্ষণে নিদারুণ আক্রোশ। এই লোক তার যেমন ক্ষতি করেছে তেমন যেন আর কেউ কখনো করে নি। চাকর এসে কিছু বলার ফুরসত পেল না। যশোমতী ঝাঁঝিয়ে উঠল, যেতে বলে দাও, দেখা হবে না।
চাকর হুকুম পালন করল। এসে জানালো দেখা হবে না।
শঙ্কর সারাভাই স্থির দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে ফিরে চলল।
জানলায় দাঁড়িয়ে যশোমতী দেখছে। তার চোখ-মুখ জ্বলছে।
রাতে বাড়ি ফিরে শঙ্কর দিদিকে শুধু বলল, চেকটা চন্দ্রশেখর বাবুকে ফেরত দিয়ে এলাম। মেয়েকেই দিতে গেছলাম, সে দেখা করল না, তাই অফিসে গিয়ে তার বাবার হাতেই দিয়ে এলাম।
দিদি হতভম্ব কিন্তু একটি কথাও আর জিজ্ঞাসা করতে পারল না। ভাইয়ের পরিবর্তনটা এ ক’দিন সে খুব ভালো করেই লক্ষ্য করেছে।
.
জ্বালা জ্বালা-যশোমতীর বুকে রাজ্যের জ্বালা। তাকে দ্বিগুণ হাসতে হচ্ছে, দ্বিগুণ হৈ-চৈ করে বেড়াতে হচ্ছে। বাড়ির লোকেরা মাসের কতকগুলো দিন মুছে দিতে পেরেছে, ও পারছে না কেন? বাবা আবার ভাবা শুরু করেছে, বিশ্বনাথ যাজ্ঞিকের সঙ্গে এবারে বিয়ের আলোচনায় এগোলে হয়। মা রমেশ চতুর্বেদীকে বিয়ে করার জন্যে আগের মতোই তাকে তাতিয়ে তুলতে চেষ্টা করছে। দাদা আবার তার শালা বীরেন্দ্র যোশর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠছে। শিবজী দেশাই আর ত্রিবিক্রম ঘন ঘন দেখা করার ফাঁক খুজছে।
সকলেই ডাকছে তাকে। সকলেই সাদরে নেমন্তন্ন করছে। নিজের বন্ধুরা, মায়ের বন্ধুরা। বাড়ি থেকে পালিয়ে যশোমতী যেন মন্ত একটা কাজ করে ফেলেছে। এদিকে বাবা-মা রীতিমত তোয়াজ করে চলেছে তাকে।
কিন্তু ভালো লাগে না। যশোমতীর কিছু ভালো লাগে না। সকালে ঘুম ভাঙলেই পুকুরঘাটে স্নানরত এক পুরুষের শুচি মূর্তি চোখে ভাসে বলেই যত যাতনা। এক কচি শিশুর ‘মাসি’ ডাক কানে লেগেই আছে। আর সেই ভাঙা কারখানায় কর্মরত পুরুষের মূর্তি আর তার রাগ আর তার অসহিষ্ণুতার স্মৃতি কতবার যে মন থেকে উপড়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করেছে আর করছে, ঠিক নেই। লোকটা টাকা ছাড়া আর কিছু চেনে না, টাকা ছাড়া আর কিছু দেখতে শেখে নি–টাকার লোভে সে যেন তাকে জীবনের সব থেকে চরম অপমান করেছে। তাকে সে জীবনে ক্ষমা করবে না। কিন্তু তবু, তবু পুরুষের সেই সবল সংগ্রামের স্মৃতি কিছুতে ভুলতে পারে না। গাঁয়ের সেই কটা দিন যেন এক অক্ষয় সম্পদ। সেই সম্পদের ওপর এমন লোভের কালি মাখিয়েছে যে, তাকে সে ক্ষমা করবে কি করে?
অথচ এদিকে জলো লাগে সব। এই সম্পদ, এই আভিজাত্যে মোড়া দিন–এ-যে এত নিষ্প্রাণ এ-কি আগে জানত? ব্যাঙ্ক থেকে যেদিন তাকে ফোনে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল টাকা দেওয়া হবে কিনা, সেইদিন লোকটার ওপর যেমন দুর্বার আক্রোশে ঝলসে উঠেছিল তেমনি রাগও হয়েছিল নির্লজ্জের মতন আবার যেদিন সে দেখা করতে এসেছিল। তাকে দেখামাত্র মুহূর্তের জন্য যে আনন্দের অনুভূতি মনে জেগেছিল সেই জন্যে নিজেকেই যেন ক্ষমা করতে পারেনি যশোমতী।
টাকা-সর্বস্ব লোভ-সব অপদার্থ কোথাকার। ওই ভাবে অপমান করে তাকে বিদায় করতে পেরে একটু যেন জ্বালা জুড়িয়েছিল যশোমতীর।
কিন্তু তার এই মানসিক পরিবর্তনের ওপর কেউ যে তীক্ষ্ণ চোখ রেখেছে, যশোমতী তা জানেও না।
তার বাবা-মা।
চন্দ্রশেখর পাঠক চিন্তিত হয়েছে। আরো অবাক হয়েছে ছেলেটা অমন বেয়াড়া মুখে পঞ্চাশ হাজার টাকার চেকটা ফেরত দিয়ে যেতে। বুদ্ধিমান মানুষ, মেয়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এই টাকা ফেরত দেওয়াটা খুব বিচ্ছিন্ন করে দেখল না সে। একটা নিগুঢ় চিন্তা তার মনে উঁকি ঝুঁকি দিতে লাগল। যত টাকা আর যত প্রতিপত্তিই থাকুক, সে ব্রাহ্মণ মানুষ, অব্রাহ্মণ কোনো ছেলের হাতে মেয়ে দেওয়ার কথা সে চিন্তাও করতে পারে না। আর এই ব্যাপারে তার স্ত্রী তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।
তাই টাকা ফেরত দেওয়া প্রসঙ্গে মেয়েকে কিছুই বলল না। ভদ্রলোক। তার মেসোর কাছে ছেলেটার সম্পর্কে খোঁজখবর নিল একটু। এবং প্রত্যেক দিনই তার চিন্তা বাড়তে লাগল। মেয়ে যেন তার সেই মেয়েই নয়। ভেবেচিন্তে দিন কয়েক বাদে মেসোর মারফত শঙ্কর সারাভাইকে ডেকে পাঠালো চন্দ্রশেখর পাঠক। প্রকারান্তরে ছেলেটিকে একটু বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। পঞ্চাশ হাজার টাকা তাকে আবার দিয়ে সেই সঙ্গে আরো বড় কিছু বিত্তের লোভ দেখিয়ে তাকে বশ করে এবাধা দূর করা যায় কিনা, সেই চেষ্টাটাই তার মাথায় এলো।