ব্যাঙ্কের সময় পার হয়ে গেছে আজ। একবার মেসোর বাড়ি যাবে কিনা ভাবল। কিন্তু সোজা স্টেশনের দিকেই চলল শেষ পর্যন্ত।
উড়েই চলল। চিন্তা একটু স্থির হতেই মনে হল, পকেটের কাগজটা টাকাই–পঞ্চাশ হাজার টাকা। যে লোকটা কাগজে ছবি দেখে সন্দেহ করেছিল, আর তাকে সকালে ডেকে নিয়ে কাগজ দেখিয়েছিল, তাকে অন্তত হাজার পাঁচেক টাকা দেওয়া উচিত।…. দিতে ভালো লাগছে না বটে, কিন্তু তাই দেবে। তাহলেও পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা থাকল।
গলা ছেড়ে হাসতে ইচ্ছে করছে শঙ্কর সারাভাইয়ের।
.
০৯.
দিদি শুনে একেবারে আকাশ থেকেই পড়ল বুঝি। বিহারীও তাজ্জব।
আর এদের উত্তেজনা এবং উদ্দীপনা দেখে ক্ষুদ্রকায় রাজুরও মনে হল তাজ্জব হবার মতো ব্যাপারই কিছু ঘটে গেছে।
বড়ঘরের মেয়ে এ-অবশ্য দিদির বরাবরই মনে হয়েছিল। কিন্তু সে-যে সাক্ষাৎ কুবেরনন্দিনী–এ ভাবে কি করে? প্রাথমিক উত্তেজনা কমার পর দিদির কেবলই মনে হতে লাগল, মেয়েটার কত রকমের অসুবিধা-হয়েছে। অথচ হাসিমুখেই সে তার মধ্যে কাটিয়ে গেছে। অসুবিধের কথা বলে ফেলে বা অসুবিধেটা ধরা পড়ে গেলে নিজেই লজ্জা পেয়েছে। ভাইকে অনুযোগও করেছে দিদি, বলেছে, তুই তো এর ওপর আবার ঠাস ঠাস কথা শুনিয়েছিস মেয়েটাকে, যা নয় তাই বলেছিস।
সেকথা শঙ্কর সারাভাইয়ের এক-এক বার যে মনে হয় নি তা নয়। নিজের আর যশোমতীরও অনেক কথাই মনে পড়ছে তার। আর কেমন যেন অজ্ঞাত অস্বস্তি একটু। তাই তার ফলে যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আর মাথা না ঘামাতেই চেষ্টা করেছে সে।
ভাঙা কারখানা-ঘরে এসে বসেছে। সেই ভাঙা ঘর চোখের সামনে চকচকে ঝকঝকে নতুন হয়ে উঠছে যেন। পুরনো মেশিনের জায়গায় নতুন মেশিন দেখছে সে। একটার জায়গায় তিনটে দেখছে। চোখের সামনে একটা ভর ভরতি ফ্যাক্টরি দেখছে।
রাতে ভালো ঘুম হল না। পরদিন সকালে পুকুরে চান করতে করতে বুকের তলায় কেমন যেন খচ করে উঠল একটু।….ভাগ্নের হাত ধরে হাসিমুখে একজন এসে দাঁড়াত। কালও দাঁড়িয়েছিল। ঘুম ভাঙলেই মুখ-হাত ধুয়ে চলে আসত। মুখখানা ভেজা-ভেজা লাগত। দু’দিন যেতে শঙ্কর বলতে গেলে অপেক্ষাই করত তার জন্যে।
আর কেউ এসে দাঁড়াবে না।
না, ভাবতে গেলেই কেমন অস্বস্তি। বড়লোকের মেয়ের ভাবনায় কাজ নেই।
তাড়াতাড়ি চান সেরে কারখানা-ঘরে গিয়ে ঢুকল। সকাল আটটা বাজতে বিহারী খাবার নিয়ে এলো। শঙ্করের আর একবার মনে হল যশোমতীর কথা। সে-ই খাবার নিয়ে আসত। এই স্মৃতিটাও শঙ্কর বাতিল করে দিল তক্ষুনি। ফ্যাক্টরিটা এবারে কোন্ প্ল্যানে দাঁড় করাবে সোৎসাহে বিহারীর সঙ্গেই সেই আলোচনা শুরু করে দিল। দেরি হয়ে যাচ্ছে খেয়াল ছিল না, খেয়াল হতেই ছুটল স্টেশনের দিকে।
ট্রেন থেকে নেমে বাসে চেপে ব্যাঙ্কে যখন এলো, তখন বারোটা বেজে গেছে। বুকের ভিতরটা দুরুদুরু করতে লেগেছে আবার। ব্যাঙ্কে চেক পেশ করতে একজন বলল, আজ তো হবে না….শনিবার, সময় পার হয়ে গেছে।
শঙ্কর সারাভাই যেন বড়সড় ধাক্কা খেল একটা। বার-টার সব ভুল হয়ে গেছে তার। টাকাটা সোমবার পাবে তাহলে। পেয়ে এইখানেই আবার নিজের নামে জমা করে যাবে।….কিন্তু পাবে তো?
দ্বিধা কাটিয়ে জিজ্ঞাসা করল, চেকটা দেখুন তো, সোমবার এলে টাকাটা পাওয়া যাবে তো?
ভদ্রলোক চেকটার দিকে ভালো করে তাকালো একবার। টাকার অঙ্ক দেখে তার চক্ষুস্থির হল একটু। বেয়ারার চেকে এত টাকার চেক কাটা হয়েছে, এ যেন কেমন লাগল তার। শঙ্কর সারাভাইকে এক নজর দেখে নিল ভালো করে। পঞ্চাশ হাজার টাকা নেবার মত মর্যাদাসম্পন্ন লাগল না তাকেও। কৌতূহলবশতই খাতা খুলে চেক দাত্রীর সইটা মেলাল সে। মিলল বটে, কিন্তু দ্রুত স্বাক্ষর গোছের লাগল।
তাকে অপেক্ষা করতে বলে চেক হাতে নিয়ে লোকটি এক কোণে চলে গেল। শঙ্কর সারাভাই দেখল সে ফোন কানে তুলে নিয়েছে।
হ্যাঁ, চেক যে কেটেছে, অর্থাৎ চন্দ্রশেখর-কন্যা যশোমতীকেই ফোন করল সে।….এ রকম একটা চেক এসেছে, পেমেন্ট হবে কিনা।
–হবে। দিয়ে দিন। ঝপ করে টেলিফোনের রিসিভার প্রায় ছুঁড়েই ফেলেছে যশোমতী।
লোকটি ফিরে এসে বলেছে, সোমবার পেমেন্ট হবে, বেলা একটার মধ্যে আসবেন।
সেদিনও শঙ্কর মেসোর বাড়িতে গেল না। বাড়িই ফিরল। টাকাটা যে পাওয়া যাবে তা বোঝা গেল। নিশ্চিত বোধ করতে চেষ্টা করল। কিন্তু বিপুল আনন্দের বদলে কি রকম যে লাগছে সে ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারছে না।
পরদিন চানের সময় আবারও একটা মিষ্টি স্মৃতি চোখে ভেসে উঠল। ওদিকে রাজু দিন-রাতই মাসির কথা বলছে। সকালের খাবার সময় তাকে মনে পড়ে। দুপুরেও। কি কথা হত, কিভাবে কথা কাটাকাটি হত। শঙ্কর কাজ ভুলে গেল। গোড়ার দিনে বাসের যোগাযোগ থেকে শুরু করে এ-পর্যন্ত খুটিনাটি কত কি যে মনে পড়তে লাগল ঠিক নেই। শঙ্কর সারাভাই আপন মনে মিটিমিটি হাসে এক একসময়। চাকরির জন্যে দেখা করতে গিয়ে ওভাবে স্কুল থেকে চলে আসার কথা মনে পড়তে বেশ জোরেই হেসে উঠেছিল। কেন যে কাগজ হাতে নিয়েই অমন উধ্বশ্বাসে পালিয়েছিল, সেটা এখন আর বুঝতে বাকি নেই।
দুপুর না গড়াতে প্রায় লাফাতে লাফাতে মেসো এসে হাজির। সঙ্গে মাসি। তার হাজার টাকার সম্বন্ধে একটি কথাও জিজ্ঞাসা করল না কেউ। আনন্দে আটখানা দুজনেই। একটা কাজের মতো কাজ করেছে শঙ্কর। তার আত্মীয় বলে বড়কর্তার কাছে মেসোরই নাকি কদর বেড়ে গেছে। মেসো বার বার অফিসে গিয়ে তাকে বড়সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে বলে গেল। আর দিদিকে বলে গেল, তার ভাই ইচ্ছে করলেই বড়সাহেবের মিলের একজন পদস্থ অফিসার হয়ে বসতে পারে এখন। চন্দ্রশেখর পাঠক নিজেই নাকি শঙ্করের মেসোকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করেছে।