কত রকমের লোক আছে সংসারে তাই যেন নিষ্পলক চেয়ে চেয়ে দেখছে যশোমতী। দেখছে, একটা স্টেশন এলেই অস্বস্তিতে ছটফট করছে লোকটা। আর তারপর আবার ট্রেন চলার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশ হাজার টাকার আলো দেখছে ওই মুখে।
সমস্তক্ষণ আর একটিও কথা বলল না যশোমতী। শুধু দেখল। একই ভাবে একই চোখে দেখে গেল।
গন্তব্য স্থানে ট্রেন এসে দাঁড়াল। আর তারপর শঙ্কর সারাভাই যেন হকচকিয়ে গেল কেমন। ছোট স্টেশনে বহুলোক এসেছে যশোমতীকে নিতে। মিল-মালিক আর কটন চেম্বারের প্রেসিডেন্ট চন্দ্রশেখর পাঠক এসেছে, আর তার স্ত্রী এসেছে, ছেলে ছেলের বউ এসেছে। রমেশ চতুর্বেদী, বীরেন্দ্র যোশী, বিশ্বনাথ যাজ্ঞিক, শিবাজী দেশাই, ত্রিবিক্রমও এসেছে। যশোমতীর অনেক বান্ধবীও এসেছে।
এই ব্যবস্থা যশোমতীর বাবা-মায়ের। স্টেশনে এসে মেয়ের কি মূর্তি দেখবে ভেবে ভরসা করে শুধু নিজেরা আসতে পারেনি। অনেক লোক দেখলে মেয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টা করবে। স্ত্রীর ব্যবস্থায় এবারে আর বাদ সাধে নি তার কর্তাটি।
তাই হল। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে যশোমতীর এতক্ষণের মুখভাব বদলে গেল। হাসি-ভরা মুখেই নামল সে। আর তাই দেখে আত্মীয় পরিজনেরাও কলহাস্যে মুখরিত হয়ে উঠল। বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, এমন কথা কেউ উচ্চারণও করল না। যেন অতি আদরের কেউ অনেকদিন বাদে অনেক দূর থেকে ফিরে এলো–সেই আনন্দ আর সেই অভ্যর্থনা।
হাসিমুখেই যশোমতী বাবা-মাকে প্রণাম করল, আর যারা এগিয়ে এলো তাদের কুশল সংবাদ নিল।
একপাশে দাঁড়িয়ে শঙ্কর সারাভাই চুপচাপ দেখছে। তার দিকে তাকানোর ফুসরত কারো নেই। এই মেয়ে তাদের গরীবের বাড়িতে এতদিন কাটিয়ে গেল এযেন আর ভাবা যাচ্ছে না।
ফিরে চলল সকলে। পায়ে পায়ে শঙ্করও এগোচ্ছে। তার মুখে সংশয়ের ছায়া। স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে হঠাৎ ফিরে তাকালো যশোমতী। তারপর বাবাকে কি বলতেই ভদ্রলোক শশব্যস্ত এবার শঙ্করের দিকে এগলো। সানন্দে তার দুই হাত ধরে ঝাঁকানি দিয়েই থমকালো একটু।–তোমাকে….আপনাকে কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে।
শঙ্কর সারাভাই মাথা নাড়ল। অর্থাৎ দেখেছে ঠিকই। দ্বিধা কাটিয়ে মেসোর পরিচয় দিল। এই বাড়তি পরিচয়টুকু পেয়ে চন্দ্রশেখর পাঠক কৃতজ্ঞতার উচ্ছ্বাস বর্ষণ করতে করতে তাকে একটা গাড়িতে তুলে দিল। নিজে সকন্যা আর সস্ত্রীক অঙ্গ গাড়িতে উঠল। এখন আর বাড়ি ধাওয়া করা ঠিক হবে না ভেবে এক ছেলে-বউ ছাড়া অন্য সকলে স্টেশন থেকে বিদায় নিল।
আঙিনায় গাড়ি ঢুকতে শঙ্কর সারাভাইয়ের দুই চক্ষু বিস্ফারিত। বাড়িতে ঢুকল কি কোনো রাজপ্রাসাদে, হঠাৎ ঠাওর করে উঠতে পারল না।
গাড়ি থেকে নামতে যে প্রকাণ্ড হলঘরে তাকে নিয়ে যাওয়া হল, তার ব্যবস্থা আর সাজ-সরঞ্জাম দেখেও শঙ্কর সারাভাইয়ের চোখে পলক পড়ে না। কোন্ বাড়ির মেয়ে এতগুলো দিন তাদের ভাঙা ঘরে কাটিয়ে এলো, এখানে এসে বসামাত্র সেটা এখন ঘন ঘন মনে পড়তে লাগল।
ঘরে ঢুকেই যশোমতী ধুপ করে একটা সোফায় বসল। বাবা-মা দাদাবউদি তখনো দাঁড়িয়ে। বসেই শঙ্করের দিকে তাকালো একবার। শঙ্কর সারাভাইয়ের মনে হল, চকচকে দৃষ্টিটা যেন মুখের ওপর কেটে বসল হঠাৎ।
–আমার চেকবই আনতে বলো।
কার উদ্দেশ্যে এই আদেশ যশোমতীর শঙ্কর বুঝে উঠল না। হুকুম শুনে বাবা বুঝল চেক বইয়ের দরকার কেন। বলল, তুই ব্যস্ত হচ্ছিস কেন, আমি দেখছি–
দ্বিগুণ অসহিষ্ণুতায় ঝাঁঝিয়ে উঠল যশোমতী।–আমার চেকবই আনতে বলে এক্ষনি! যেটা নিয়ে বেরিয়েছিলাম সেটা চুরি হয়ে গেছে, অন্য যা আছে আনতে বলো শিগগীর।
হন্তদন্ত হয়ে দাদাই ছুটল। শঙ্কর সারাভাইয়ের বুকের ভিতরটা দুর করছে।
দু’মিনিটের মধ্যে দুটো চেক-বই হাতে নিয়ে দাদা ফিরল। যশোমতী সেই ট্রেনের মতোই স্তব্ধ এখন। একটা চেকবই টেনে নিতেই বাবা তাড়াতাড়ি কলম খুলে ধরল তার সামনে।
খস খস করে পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক লিখে পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে যশোমতী ছুঁড়ে দিল সারাভাইয়ের দিকে।–এই নিন। ভালো করে দেখে নিন। তারপর চলে যান!
জ্বলন্ত চোখে এক পশলা আগুন ছড়িয়ে নিজেই সে দ্রুত ঘর ছেড়ে প্রস্থান করল। চেকটা ছুঁড়ে দেওয়ায় সেটা মাটিতে গিয়ে পড়েছিল। গণেশ পাঠক সেটা তুলে নিয়ে বোবামূর্তি শঙ্কর সারাভাইয়ের হাতে দিল। বিমুঢ় মুখে চেকটা নিল সে। যশোমতীর মা তাড়াতাড়ি মেয়ের পিছনে পিছনে চলে গেল। বউদিও।
চন্দ্রশেখর পাঠক মেয়ের ব্যবহারে অপ্রস্তুত একটু। কাছে এসে বলল, কিছু মনে কোরো না, মেয়েটার এই রকমই মেজাজ। টেক গিলে জিজ্ঞাসা করল, আসার সময় গণ্ডগোল করে নি তো?
শঙ্কর সারাভাই মাথা নাড়ল।
চন্দ্রশেখর তার পিঠে হাত রাখল, তারপর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল, তারপর অফিসে তার সঙ্গে দেখা করতে বলল, আর তারপর মেয়ের উদ্দেশে প্রস্থান করল।
শঙ্কর সারাভাই রাস্তায় এসে দাঁড়াল। আয়নায় এই বোকামুখ দেখলে নিজেই অবাক হত। পরক্ষণে সর্বদেহে এক অননুভূত রোমাঞ্চ। বুকপকেটে চেকটা খসখস্ করছে। বার করে দেখল। হাত কঁপছে। পড়ল। চোখে ধাঁধা লাগছে।
যা হয়ে গেল, সব সত্যি কিনা নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এক মেয়ে কলম নিয়ে খসখস করে পঞ্চাশ হাজার টাকা লিখে দিল বলেই এই কাগজটার দাম সত্যি পঞ্চাশ হাজার কিনা, সেই অস্বস্তিও মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।….পঞ্চাশ হাজার….পঞ্চাশ হাজার টাকা….কপর্দকশূন্য শঙ্কর সারাভাই পঞ্চাশ হাজার টাকার মালিক। আজ এই মুহূর্তে, সে-কি সত্যিই বিশ্বাস করবে? তার হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা, একি সে স্বপ্ন দেখছে?