কিন্তু এ চিন্তার খবর যশোমতী রাখে না। প্রস্তাব নাকচ করা হয়েছে এইটুকুই সে বুঝেছে, আর এই জন্যই সে ক্ষুণ্ণ মনে মনে।
জিজ্ঞাসা করেছে, নিতে আপনার আপত্তি কেন?
শঙ্কর সারাভাই হাসিমুখে পাল্টা প্রশ্ন করেছে, আপনার গায়ের গয়না আমি নেব কেন?
তর্ক করতে গিয়েও যশোমতী হেসে ফেলেছিল, তবে কার গায়ের গয়না নেবেন?
শঙ্কর জবাব দিতে পারেনি। লোভ সামলে মুখ টিপে হেসেছে।
ছাড়বার পাত্রী নয় যশোমতী, গলায় ঝগড়ার সুর।–নেবেন না-ই বা কেন, আমি আপনার বাড়িতে চড়াও হয়ে বসেছি কি করে?
ঠাট্টার সুরেই শঙ্কর সারাভাই জবাব দিয়েছে, বসেছেন সে-কি আমার হাত? এই জবাবে পাছে অহিত হয় সেই জন্যেই আবার বলেছে, আমি গরীব বটে, কিন্তু মনটাকে গায়ের গয়না খুলে নেবার মতো গরীব ভাবা গেল না।
ক্ষুণ্ণ হলেও জবাবটা ভালো লেগেছিল যশোমতীর।
পরদিনই আবার আর এক প্রস্তাব নিয়ে সোৎসাহে হাজির সে। বলল, আচ্ছা, কটন চেম্বারের এগজিবিশনে শাড়ি পাঠান না কেন? তাদের বিচারে প্রথম হতে পারলেও তো পঁচিশ হাজার টাকা পুরস্কার পেয়ে যাবেন?
শঙ্কর সারাভাই অবাক।–কটন চেম্বারের খবর আপনি রাখেন কি করে?
ছদ্মবিস্ময়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ টান করে ফেলে যশোমতী।–ও মা, কাগজে বেরোয়, কত ঘটা হয়, খবর রাখব না কেন? আমার এক বন্ধুর দাদাই তত একবার পেয়েছে।
মিথ্যে বলেনি। তবে বন্ধুর দাদার পুরস্কার পাওয়ার মধ্যে তারও যে পরোক্ষ হাত ছিল, সেটাই শুধু গোপন। পুরস্কার পাওয়ানোর জন্য বিচারকদের আগের থেকে বশ করতে হয়েছিল।
শঙ্কর সারাভাই জবাব দিল, আপনার বন্ধুর দাদার তাহলে মুরুব্বির জোর আছে। সাধারণ বেড়ালের বেলায় ওই ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে না।
খুব ছেড়ে। এভাবে হাল ছাড়তে দিতে রাজি নয় যশোমতী।– আপনি চেষ্টা না করে বলছেন কেন? কখনো পাঠিয়েছেন? পাঠান নি? আচ্ছা, ও-সব ভাবনা ছেড়ে এবারে তাহলে খুব ভাল দেখে একখানা শাড়ি পাঠান, কার কপালে কখন কি লেগে যায় কে বলতে পারে! আমার মন বলছে আপনিই পেয়ে যাবেন।
এ প্রস্তাবটা আগেরটির থেকেও অর্থাৎ গায়ের গয়না খুলে নিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টার থেকেও অবাস্তব মনে হয়েছিল শঙ্কর সারাভাইয়ের। কিন্তু তবু ভাল লাগল। তার জন্যে এতখানি মন দিয়ে কেউ ভাবছে, এই যেন এক দুর্লভ ব্যাপার। তবু, এ প্রস্তাবও হেসেই উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল সে। বলল, মনে মনে আপনি নিজেই বিচারক হয়ে বসেছেন কিনা, তাই মন বলছে।
কিন্তু এই এক ব্যাপার নিয়ে যশোমতী রোজ উৎসাহ দিতে লাগল, রোজ তর্ক করা শুরু করল। আর এই প্রেরণাটুকুই হয়তো শঙ্কর সারাভাইয়ের নিজের অগোচরে মনের তলায় কাজ করতে লাগল। খুব অগোচরেও নয়। পুরস্কার পাক না পাক, তার শুকনো হতাশ মনটাকে যে চাঙা করে তুলতে পেরেছে এই প্রাপ্তি টুকুরও দুর্লভ স্বাদ। যশোমতীর উৎসাহ দেখে আর তার অবুঝ ঝোঁক দেখে শেষ পর্যন্ত তাকে খুশি করার জন্যেই যেন রাজি হল, এগজিবিশনের বিচারে শাড়ি পাঠাবে। পাঠানটা খুব কঠিন ব্যাপার তো কিছু নয়, খুব ভেবে-চিন্তে খেটেখুটে করা।
এই নিয়েই তারপর দুজনের আলাপ-আলোচনা চলতে লাগল। আর, এই আলোচনার ফল সত্যিকারের কাজের দিকে গড়াতে লাগল। শঙ্কর সারাভাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, পাড়, আঁচল ইত্যাদির বৈশিষ্ট্যের দিক নিয়ে জল্পনা-কল্পনাও এই মেয়ের মাথায় বেশ আসে। অন্তত অজ্ঞ বলা চলে না। এই বিস্ময়ই ক্রমশ তাকে আশার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কিনা কে জানে।
সেদিন শঙ্কর সারাভাই যশোমতীর নৈমিত্তিক তাগিদের ফলেই জানালো, সামনের পনেরো দিনের মধ্যেই দেব-উঠি-আগিয়ারস, এর উৎসব, এই উৎসবের দিন সারবতীতে চান করে এবং পুজো দিয়ে রাত্রিতে কারখানার প্রথম কাজ শুরু করেছিল। অবশ্য তার ফল যে আশাপ্রদ হয়েছে তা নয়। তবু, সেই দিনটা এলেই নতুন করে আবার আনন্দ করতে ইচ্ছে করে…. এগজিবিশনের শাড়ির ব্যাপারেও তাই করবে। খুব ভোরের ট্রেনে চলে যাবে, দুপুরের মধ্যে চান আর পুজো সেরে চলে আসবে, বিকেলে দুজনে একসঙ্গে পুরস্কারের শাড়ির কাজ শুরু করবে। প্রতি বছরেই ওই দিনটিতে সে নাকি সাবরমতীতে গিয়ে থাকে।
শুনে যশোমতী ভারী খুশি। পুরস্কারটা যে এবারে এখানেই আসবে তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। ও কোথায় আছে না জানিয়ে বাবাকে যদি সে এই শাড়ির দিকে চোখ রাখার জন্যে একটা চিঠি শুধু লিখে দেয়, তাতেই কাজ হবে।….চিঠি লিখলে আবার ডাকের ছাপ দেখে হদিস পেয়ে ফেলতে পারে। দূরের কোনো জায়গা থেকে পোস্ট করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যাক, চিঠি লিখবে কি অন্ত কিছু ব্যবস্থা করবে সেটা পরের ভাবনা, এখন দুর্গা বলে আরম্ভ তত করা যাক।
কিন্তু ওপরঅলার ইচ্ছে অন্যরকম।
বিকেলের দিকে রাজুর হাত ধরে যশোমতী এদিক-সেদিক বেড়াত একটু। সেদিন দেখল, দূর থেকে একজন লোক যেন তাকে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করছে। লোকটার বয়েস বেশি নয়, চাউনিটাও যেন কি রকম।
বিরক্ত হয়ে সেদিন যশোমতী ঘরে চলে এলো। শহরে পুরুষের এই রোগ কম দেখে নি, গাঁয়ে ইতিমধ্যে আর এই উৎপাত ছিল না। পরদিন সকালে তরকারীর বাগানে ঘুরতে ঘুরতে আবার সেই লোকটাকে দেখা গেল। বিকেলেও। যশোমতী রেগেই গেল, ভাবল শঙ্কর সারাভাইকে বলে দেবে। লোকটার নির্লজ্জতা স্পষ্ট। কিন্তু বলতে লজ্জা করল। দরকার হলে এ-রকম দু-একটা লোককে নিজেই ঢিট করতে পারে। বলল না। তবে বললে প্রতিক্রিয়া কি হয় তা দেখার লোভ হয়েছিল।