বিশেষ করে দুপুরে কারখানা-ঘরে যেন তার প্রতীক্ষাতেই থাকে। কারখানা….যশোমতীর হাসিই পায়। বাবার কারখানা যদি একবার দেখত।
দুপুরে সেখানে হাজিরা দেওয়া নৈমিত্তিক কাজে দাঁড়িয়েছে যশোমতীর। ইদানীং আবার দুপুরের খাবারটা সে-ই নিয়ে যাচ্ছে। ঢেকে রাখতে বললে রীতিমত তাড়না শুরু করে দেয়, মুখ-হাত ধুয়ে শঙ্করকে খেতে বসতে হয়। বিকেলের চা নিয়েও সে-ই আসছে। এই চা নিয়েও সেদিন একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে।
যশোমতী বলে ফেলেছিল, কি যে জায়গা, একটু ভালো চা-ও মেলে না–এই চা গলা দিয়ে নামতে চায় না।
এ-বাড়িতে নিয়মিত চায়ের পাট ছিলই না। চা-বিহনে যশোমতীর দুই-একদিন মাথা ধরতে দিদি জানতে পেরে চায়ের ব্যবস্থা করেছে। শঙ্কর পেলে খায়, না পেলে খায় না। কিন্তু যশোমতী ভাবখানা এমন করল যেন এই লোকের জন্যেই চায়ের ব্যবস্থা।
দিদি অনেকবার ভাইকে বলেছে, মেয়েটার চাল-চলনে কথায় বার্তায় আচার-আচরণে সর্বদাই মনে হয় বড়ঘরের মেয়ে। এমন কি বিহারীও বলেছে, নতুন দিদিমণি নিশ্চয় খুব বড় ঘরের মেয়ে ছিল। তাকেও কিছু দেবে-টেবে–এই রকম প্রতিশ্রুতি পেয়েছে হয়তো।
চায়ের প্রসঙ্গে শঙ্কর বলে বসল, ভালো চা কি করে পাওয়া যাবে, আপনার মতো ভালো অবস্থার লোক তো এখানে বেশি নেই।
যশোমতীও ঝপ করে বলে বসেছে, নেই সে-কথা সত্যি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হেসে ফেলে মনোভাব গোপন করতে চেষ্টা করেছে। –আমার কি অবস্থা আমি খুব ভালো জানি, সেজন্যে অত খোটা দেবার দরকার কি!
কিন্তু দুপুর এলেই কে যেন টানে যশোমতীকে এখানে। কর্মরত মূর্তি দেখে পুরুষের। সংগ্রাম দেখে। কি অসম্ভব চেষ্টা, আর কতখানি আশা। এই কারখানা নাকি বড় হবে একদিন, মাথা উঁচিয়ে উঠবে। দিদির কাছে ভদ্রলোকের এই একমাত্র স্বপ্নের কথা শুনেছে, বিহারীর মুখেও শুনেছে। আর শুনেছে শঙ্কর সারাভাইয়ের নিজের মুখ থেকেও। বলেছে, একদিন এর এই চেহারা থাকবে না, দেখে নেবেন।
যশোমতীর বিশ্বাস হয় নি। কিন্তু সে বিশ্বাস করতে চেয়েছে।
ইতিমধ্যে সত্যিই নিজের হাতে তাকে দুখানা শাড়ি বানিয়ে দিয়েছে শঙ্কর সারাভাই। কাপড় পাওয়ামাত্র মুখ লাল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে এক অদম্য খুশির আবেগ অনুভব করেছে সে। শাড়ি অবশ্য দিদিই এনে দিয়েছিল তার হাতে।
কিন্তু শাড়ি হাতে নিয়েই যশোমতীর মনে হয়েছিল, যত্নের শাড়ি, অবজ্ঞার বা হেলাফেলার নয়। দুপুরে যখন ওই শাড়ির একখানা পরে এসেছে তখনো থেকে-থেকে মুখ লাল হয়েছে। বলল, চমৎকার শাড়ি, আপনি এত ভালো তৈরি করতে পারেন?
হাসল শঙ্করও। বলল, সরঞ্জাম থাকলে এর থেকে অনেক ভালো তৈরি করতে পারি, নেই তার কি করা যাবে।
না থাকার খেদ যেন বুকের ভেতর থেকে উঠে এলো। সেই দিনই যশোমতী দিদির কাছে শুনেছিল, বিশ হাজার টাকা দেবে এমন একজন অংশীদার যোগাড় করার জন্য তার ভাই কত চেষ্টাই না করেছে–কিন্তু কে দেবে তাকে টাকা? ওই টাকা পেলেই নাকি কারখানার ভোল বদলে যেত।
কথায় কথায় যশোমতী সেই প্রসঙ্গই তুলল। অবাক হবার মত করে জিজ্ঞাসা করল, মাত্র বিশ হাজার টাকা পেলেই আপনার সমস্ত সমস্যা মিটে যায়?
শঙ্কর সারাভাই জবাব দিতে যাচ্ছিল, বিশ হাজার টাকা একসঙ্গে দেখেছেন? তা না বলে হাসল। অতটা অভদ্র না হয়েও জব্দ করা যেতে পারে। হালকা শ্লেষে জবাব দিল, মাত্র। আপনি দেবেন?
হঠাৎ কি মনে পড়ল যশোমতীর। তার চোখে-মুখে উদ্দীপনার আভাস। সমস্যার সমাধান তো তার হাতের মুঠোয়। সাগ্রহে বলল, দিতে পারি না মনে করেন?
এ আলোচনা ভালো লাগছিল না শঙ্করের। হয়তো বড়ঘরের মেয়েই ছিল, তা বলে সদ্য বর্তমানের অবস্থা ভোলে কি করে? হেসেই টিপ্পনি কাটল, আপনি রাজুকে কি সব দেবেন বলেছেন, বিহারীও হয়তো কিছু পাবার আশ্বাস পেয়েছে, নইলে চোখ-কান বুজে ও এত প্রশংসা কারে করে না।….আমাকেও ওদের দলে ফেলাটা কি তার থেকেও একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?
-না, যাচ্ছে না। যশোমতীর নিশ্বাস ঘন হয়ে উঠল। আরো জোর দিয়ে বলল, দিতে পারি, আপনি যদি দিদিকে বা কাউকে কিছু না বলে দেন। নিজের দুটো হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিল।–এই দেখুন, আমার এই বালা দুটোর হীরেগুলোর দামই সাত-আট হাজার ছিল, আর হারের লকেটের এই একটা হীরের দামই তার থেকে অনেক বেশি। তাছাড়া সোনা আছে, আংটি আছে, বিশ হাজার কেন, তার থেকে বেশিই হবে, আপনি চেষ্টা-চরিত্র করে দেখুন না কি পান, এগুলো দিয়ে আমি আর কি করব? আপনার কাজে লাগলে সার্থক হবে–
শঙ্কর সারাভাই বিস্ময়ে নির্বাক। গায়ের গয়নাগুলো এই প্রথম যেন লক্ষ্য করে দেখল সে। চোখ ঠিকরোবার মতই ঝকঝক করছে তার পরেও মুখে কথা নেই। যশোমতীকে দেখছে, গয়না দেখছে,– দুই-ই দেখছে। গয়নাগুলোর দাম এত হতে পারে, আর তা কেউ অনায়াসে খুলে দিতে চাইতে পারে, সে ভাবতেও পারে না।
যশোমতী আবার বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, এসব আমার দাদার নয়, বাবার দেওয়া। এগুলো আমারই। এর জন্যে আপনাকে কারো কাছে কোনদিন জবাবদিহি করতে হবে না। কাজ আরম্ভ হোক তো, তারপর বাকি টাকাও যোগাড় হয়ে যাবে। নেবেন তো?
শঙ্কর সারাভাই এই একান্ত অনুরোধ সত্ত্বেও লোভ দমন করেছে বটে, কিন্তু জীবনে সে যেন এক পরম বিস্ময়ের মুখোমুখি হয়েছে। সমস্ত রাত ঘুমুতে পারেনি। সে ভেবে পাচ্ছে না, সত্যিই কে তার ঘরে এসে উঠেছে। ওই একটা মাত্র প্রস্তাব যে তাকে কোন্ অনুভূতির রাজ্যে নিয়ে গেছে তা শুধু সে-ই জানে। কারখানা দাঁড়াবে, কারখানা অনেক বড় হবে জীবনে এর থেকে বেশি কাম্য আর কিছু নেই। যে এতখানি দেবার জন্য এগিয়ে এলো, সে নিজে কখনো সরে যাবে না এরকম প্রতিশ্রুতি নিয়ে সত্যি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া যায় কিনা, সেই প্রলোভনও মনে অনেকবার আনাগোনা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মন থেকে সায় মেলে নি। শুধু প্রতিশ্রুতিটুকু আদায় করার লোভ বার বার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে।