এই মানসিক অবস্থায় এ-রকম একটা প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না যশোমতী। থতমত খেল। মুখ ঘুরিয়ে তাকালো তার দিকে। –সার্টিফিকেট? আনিনি তো….
চট করে এও মাথায় এলো না যে বলবে, সার্টিফিকেট ও ব্যাগের সঙ্গেই চুরি গেছে। এ-রকম প্রশ্ন কেন তাও ভাবার অবকাশ পল না। নিছক সত্যি কথাটাই বলে ফেলেছে।
দৃষ্টি ঘোরালো শঙ্কর সারাভাইয়ের চাকরি কি আপনার মুখ দেখে হয়ে যাবে ভেবেছিলেন? স্কুলে চাকরির চেষ্টায় এসেছেন আর ডিগ্রীর সার্টিফিকেট সঙ্গে আনেন নি?
আবার কিছু একটা বিড়ম্বনার মধ্যে টেনে আনা হচ্ছে তাকে। যশোমতী মাথা নাড়ল শুধু। আনেনি।
একটু থেমে শঙ্কর প্রায় নির্লিপ্ত মুখেই জিজ্ঞাসা করল, আপনি সত্যিই বি, এ. পাস করেছেন?
কি! সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে উঠল। রাগে আবার সেই রকমই মুখ লাল যশোমতীর।
শঙ্কর জবাবের প্রতীক্ষা করছে, সন্দেহ যখন হয়েছে রাগ-বিরাগের ধার ধারে না।
আবার ভেবে-চিন্তে জবাব দেবার ব্যাপারে ভুল হয়ে গেল যশোমতীর। সন্দেহটা স্পষ্ট হওয়া মাত্র মাথা আরো বিগড়েছে। বলে উঠল, আপনি ওখানকার মেয়ে-কলেজে চিঠি লিখে দেখুন সত্যি কি মিথ্যে, এম. এ-ও পড়েছি কিনা য়ুনিভার্সিটিতে লিখে জেনে নিতে পারেন–
পর মুহূর্তে খেয়াল হল, সত্যিই লেখে যদি, মিথ্যেই প্রমাণ হবে। কারণ, য়ুনিভার্সিটিতে অন্তত লীলা নায়েক বলে কেউ নেই, আর সত্যিকারের লীলা নায়েক আই. এ. পাশ করার আগেই বিয়ে করে পড়াশুনার পাট চুকিয়েছে। ফলে রাগের চোটে মাথা আবার খারাপ হবার দাখিল তার।
শঙ্কর সারাভাইয়ের দৃষ্টি পার্শ্ববর্তিনীর মুখের উপর থেকে নড়ছে না।–আপনি এভাবে চলে এলেন কেন?
যোগ্য জবাব হাতড়ে না পাওয়ার ফলেও ক্রুদ্ধ যশোমতী। বি. এ. অনার্স পাশ করে প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করব কেন?
-তাহলে আপনি দেখা করতে এলেন কেন?
-এমনি। প্রথমে ভেবেছিলাম করব, পরে মনে হল করব না। জটিলতা নিজেই পাকিয়ে তুলেছে। তাই কথার সুর আপনা থেকেই নরম একটু, বলল, আপনি বরং গানের স্কুল যেটা হবে সেখানে আগে থাকতে চেষ্টা করে দেখুন।
এবারে শঙ্করের ধৈর্য শেষ।–আমার দায় পড়েছে আপনার চাকরির চেষ্টায় ঘুরতে।
হঠাৎ যশোমতীর মনে হল, লোকটাকে আরো তাতিয়ে দিতে পারলেই এ-যাত্ৰা বাঁচোয়া। নইলে সন্দেহ আরো কোন পর্যায়ে গড়াবে ঠিক নেই।
দুর্বলতার জায়গা বেছে নিয়েই ঘা দিতে চেষ্টা করল।–দায় তো পড়েইছে, নইলে আপনার টাকা শোধ হবে কি করে?
শঙ্করও ঠাস করে জবাব দিল, আর শোধ হয়েছে! পুরুষের ওপর বসে খাওয়া আর পরা ছাড়া আপনাদের আর কোনো ক্ষমতা নেই, বুঝলেন?
বুঝলাম। কিন্তু পুরুষের ক্ষমতাও তো দেখছি, খাওয়া-পরা যোগাতেই বা ক’জন পারে!
রাগে মুখ সাদা শঙ্কর সারাভাইয়ের। সে ভেবে পায় না, এ-রকম অবস্থায় পরেও একটা মেয়ে এ-ভাবে কথা বলতে পারে কি করে।
আড়চোখে এক-একবার তাকে লক্ষ্য করছে যশোমতী, আর নিশ্চিন্ত বোধ করছে। বাড়ির কাছাকাছি এসে জিজ্ঞাসা করল, দিদিকে কি বলবেন?
ঝাঁঝালো জবাব এলো, কি বলতে হবে সেটাও আপনি অনুগ্রহ করে বলে দিন।
একটু ভেবে অনুগ্রহ করেই যেন বলে দিল যশোমতী।–বলবেন চাকরি হল না।
আর যদি জিজ্ঞাসা করে, কেন হল না?
বলবেন, প্রাইমারি স্কুলের পক্ষে ওভার-কোয়ালিফায়েড–এত বিদ্যে থাকলে অত ছোট স্কুলের চাকরি হয় না।
নিজেই বিস্মিত যশোমতী, কি যে আছে অদৃষ্টে কে জানে, রাগ দুর্ভাবনা ভুলে হাসতেও পারল।
কিন্তু শঙ্করের হাসির মেজাজ নয় আপাতত। বলল, আপনার কোন্ কথাটা সত্যি আর কোষ্টা সত্যি নয়, সেটা আমার কাছে একটুও স্পষ্ট নয়।
সঙ্গে সঙ্গে আবার অসহিষ্ণু মূর্তি যশোমতীর।–কে আপনাকে অত মাথা ঘামাতে বলেছে? দিদিকে আপনার যা খুশি বলুন গে যান, আমাকে চলে যেতে হবে এখান থেকে এই পর্যন্ত–সেটা যে আপনি সব সময়ে চাইছেন তা আমার বুঝতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। ব্যাগটা চুরি না গেলে আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারতুম টাকার পোয়া আমি করি কি না।
শঙ্কর সারাভাই চুপ। তার কেবলই মনে হতে লাগল এ-রকম মেয়ে সে জীবনে দেখেনি।
০৮-১১. সাবরমতী পরিপূর্ণ
বাড়ি ফিরে যশোমতী সত্যিই ভয়ে ভয়েই ছিল। কিন্তু লোকটা তাকে বাঁচিয়েই দিল মনে হয়। দিদি শুধু জানল, তার চাকরি হল না। আর সেটুকু শুনেই স্কুলের অজানা অচেনা কর্তাদের উদ্দেশে দিদি বিরূপ মন্তব্য করল দুই একটা। উল্টে যশোমতীকে সান্ত্বনা দিল, তুমি কিছু ভেব না, যা হোক কিছু হবেই। সম্ভাব্য গানের স্কুলের লোকেরা একবার তার গলা শুনলেই হয়তো তাড়াতাড়ি স্কুল শুরু করে দেবে। এই সঙ্গে স্যাণ্ডাল না কেনার জন্যেও ভাইকে কথা শুনতে হল।
একটা একটা করে দিন যায়। যশোমতীর মনে হয় এ-ভাবে থাকা উচিত নয়। বিবেকে লাগে। আবার এখান থেকে যাবার কথা ভাবতেও ভালো লাগে না। সকাল হলেই রাজুর হাত ধরে পুকুর-ঘাটে আসা চাই তার। এমনি রাত্রিতে বিছানায় শুয়েই সকালের ওই দেখার প্রতীক্ষায় থাকে।
তারপর যশোমতী বাগান পরিচর্যা করে খানিকক্ষণ। এও ভালো লাগে। এক-একদিন দিদি আসে, আর কাজের চাপ না থাকলে শঙ্কর সারাভাইও আসে। দুজনের খটাখটি লাগে অবশ্য, লাগে কারণ, ইচ্ছে করেই যশোমতী জ্বালাতন করে তাকে। তবু মনে হয়, রাগ হলেও লোকট। আগের মতো অত রূঢ় হতে পারে না।