দ্বিগুণ তেতে উঠল শঙ্কর সারাভাই। গাঁয়ে কেন, শহরেও চমৎকার, পাশ থেকে ব্যাগ তুলে নিয়ে গেলেও হুশ থাকে না। তা আমিই বা কি করব, মাথায় করে জুতো নিয়ে আসতে ছুটব এখন?
–তোকে কিছু করতে হবে না। দিদি বেরিয়ে গেল, আর একটু পরেই নিজের বিবর্ণ স্যাণ্ডালজোড়া এনে হাজির করে বলল, এটা পরেই কাজ চালিয়ে এসে কোনরকমে। পায়ে হবে তো আবার…. হবে বোধহয়। ভাইকে হুকুম করল, আসার সময় ওর জন্য দেখেশুনে একজোড়া স্যাণ্ডাল কিনে নিয়ে আসিস।
গরম চোখে ভাই দিদির দিকে তাকালে একবার, তারপরে যশোমতীর দিকে। অর্থাৎ সহেরও সীমা আছে একটা। কিন্তু দৃষ্টি বিশ্লেষণের জন্য অপেক্ষা না করে যশোমতী ততক্ষণে দিদির আধ ছেঁড়া স্যাণ্ডাল পায়ে গলিয়ে দাওয়ায় নেমে এসেছে।
পাশাপাশি যাচ্ছে দু’জনে। কম করে মিনিট সাত-আট সমনোযোগে রাস্তার দু’দিক দেখতে দেখতে চলল যশোমতী। মুখে একটিও কথা নেই। আড়চোখে তারপর পাশের গম্ভীর মূর্তিটি দেখল বার কয়েক, তারপর হঠাৎ যেন রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলল, এমন দেশ কে জানত, মানুষ ছেড়ে কুকুরগুলোর পর্যন্ত ভদ্রতা-জ্ঞান নেই একটু, মেয়েছেলের জুতো নিয়ে পালাল!
জবাবে শঙ্কর শুধু রুষ্ট দৃষ্টি নিক্ষেপ করল একটা।
কিন্তু তর্কের ফাঁক খুঁজছে যশোমতী। দম ফেটে এখন হাসিই পাচ্ছে তার। কিন্তু হেসে ফেললে পাশের লোকের ফিরে বাড়ির দিকে হাঁটার আশঙ্কা। গম্ভীর। একটু বাদে আবার বলল, কোনো মহিলা বিপদে পড়লে এমন চেঁচামেচি করে কেউ তাও জানতুম না। সবই বরাত, অমন একশো জোড়া জুতো খোয়া গেলেও বাড়িতে কেউ একটা কথা বলতে সাহস করত না।
শেষেরটুকু বলে ফেলে নিজেই সচকিত। বিপদ ঘটেই গেল বুঝি। সারাভাই মুখ খুলল এবার, বলল, এত কদরের বাড়ি ছেড়ে আপনি এলেন কেন তাহলে? তাছাড়া আপনার জুতো কুকুরে নিয়েছে আগেই জানতেন যখন, আগে বলেন নি কেন?
প্রথম বিপজ্জনক প্রশ্নটার জবাব এড়ানোর তাগিদে কথায় ঝঝি মেশাবার ফাঁকটুকু আঁকড়ে ধরল যশোমতী।–আগে বললে কি হত, খুশিতে আটখানা হয়ে আপনি জুতো আনতে ছুটতেন?
রাগের মাথায় শঙ্কর দাঁড়িয়ে গেল। ফলে যশোমতীও। নিঃশব্দ দৃষ্টি-বিনিময়। অর্থাৎ সে কিছু বললে যশোমতীও পাল্টা জবাব দেবেই। দেবার জন্য প্রস্তুত। ঘটা করে চোখ পাকিয়ে তাই বুঝিয়ে দিল। হাল ছেড়ে শঙ্কর সারাভাই হেসে ফেলল।
যশোমতীও।
স্কুলের আপিস-ঘর। দরোয়ান বসতে দিল তাদের। জানালো, কর্তাবাবু এখনো আসেন নি, এক্ষুনি এসে পড়বেন।
দুজনে দুটো চেয়ারে বসল। শঙ্কর টেবিলের ওপর থেকে একটা কাগজ তুলে নিল। তার অনুকরণে যশোমতীও আর একটা কাগজ তুলে নিল। চাকরির তদবিরে এসেছে, এবং না পেলে সমূহ বিপদ সেটা যেন এতক্ষণ ভুলেই ছিল। কিন্তু হাতের কাগজ খুলতেই সর্বাঙ্গে যেন তড়িত-প্রবাহের ঝাঁকুনি খেল একটা।
কাগজে যশোমতীর ছবি, আর বড় বড় হরফে তাতে পঞ্চাশ হাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা! দ্বিতীয় দিনেই বাবা পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কারের জাল ফেলেছে। কাগজটা পুরনো তারিখের।
তার এই মূর্তি দেখে ফেললে শঙ্কর সারাভাই হয়তো ঘাবড়েই যেত। কিন্তু যশোমতীর মুখ তখন হাতের কাগজের আড়ালে। এমন আড়ালে যে চেষ্টা করেও দেখার উপায় নেই।
যশোমতী কি যে করবে ভেবে পেল না। ভদ্রলোকের হাতের ওই কাগজেও আছে কিনা কিছু কে জানে। দিশেহারাই হয়ে পড়ল সে। যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, এ-ছবি হয়তো তার চোখে আগেই পড়েছে। মনে হওয়া মাত্র স্কুলের ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটাই যেন সব থেকে বড় বিভীষিকা।
কাগজ ছেড়ে যশোমতী দাঁড়িয়ে উঠল হঠাৎ। বলল, চলুন, বাড়ি যাব–
কাগজ সরিয়ে শঙ্কর সারাভাই আকাশ থেকে পড়ল। কি বলছে তাও যেন বোধগম্য হল না। এই মুখ দেখেও অবাক। ফ্যালফ্যাল করে চেয়েই রইল সে।
যশোমতী তাড়া দিল, কথা কানে যাচ্ছে? উনি, আমি এক্ষুনি বাড়ি যাব–আমার শরীর ভয়ানক খারাপ লাগছে।
হকচকিয়ে গেল শঙ্কর সারাভাই। মুখ হঠাৎ এত লাল দেখে আর এই উগ্র কণ্ঠস্বর শুনে ঘাবড়েই গেল। বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু খবর পাঠানো হয়েছে, ভদ্রলোকের সঙ্গে
আঃ! আমি চাকরি করব না এখানে, চলুন শিগগীর।
এক ঝলক আগুনের ঝাপটা লাগল শঙ্কর সারাভাইয়ের চোখে-মুখে। কিছু বোঝার আগেই যশোমতী হহ করে দরজা পেরিয়ে এগিয়ে গেছে অনেকটা।
বিমূঢ় বিস্ময়ে শঙ্কর অনুসরণ করল।
খানিকটা পা চালিয়ে আসার পর ধরা গেল তাকে। মুখ স্বাভাবিক নয় তখনো। শঙ্কর ভয়ই পেয়েছে। গতকালও দিদিকে শরীর ভালো না বলেছিল মনে পড়ল। জিজ্ঞাসা করল, কি হল হঠাৎ বলুন তো, কি খারাপ লাগছে?
ক্ষোভের মাথায় যশোমতী বলে উঠল, সব খারাপ, সমস্ত দুনিয়াটা খারাপ লাগছে, বুঝলেন?
শঙ্কর রাগ করবে কি, দুর্ভাবনা ছেড়ে তার বিস্ময়েরও শেষ নেই। মুখ এখনো সেই রকমই লাল প্রায়। চুপচাপ একটু লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করল, হেঁটে যেতে পারবেন না রিকশা ডাকব?
যশোমতীর কেন যে রাগ কাকে বলবে? জবাব দিল, থাক, রিকশা ডাকলেই তো আপনার বাজে খরচ! পরে খাটা দিতে ছাড়বেন? আবারও এগিয়ে গেল সে।
বিস্ময়ের ঘোর কাটতে হঠাৎ একটা সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিল শঙ্করের মনে। সন্দেহটা মনে আসার পর এই মুখ দেখে আর চল। দেখে এখন আর খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে না তার। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এসে চুপচাপ তার পাশে পাশে চলল, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। একটু বাদে আচমকা জিজ্ঞাসা করে বসল, আপনার ডিগ্রীর সার্টিফিকেট টার্টিফিকেটগুলো কোথায়?