-লীলা, খাবে না? দোরগোড়ায় দিদি এসে দাঁড়িয়েছে।
ধড়মড় করে চৌকি ছেড়ে নেমে দাঁড়াল যশোমতী। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমাকে বলছেন?
দিদি বিস্মিত। আর যশোমতী মনে মনে অপ্রস্তুতের একশেষ। নিজের নতুন নাম নিয়ে তৃতীয়বার গণ্ডগোল। দিদি সস্নেহে বলল, কি অত আকাশ-পাতাল ভাবছ? এসে যখন পড়েছ–সব ঠিক হয়ে যাবে, খাবে এসো।
বাইরে এসে দেখল, ভদ্রলোকটিও খাওয়ার আসনে বসে নিঃশব্দে তাকে লক্ষ্য করছে। অর্থাৎ, সে যে বিলক্ষণ ভাবনা-চিন্তার মধ্যে পড়েছে ধরে নিয়েছে। নাম নিয়ে গণ্ডগোলটা মাথায় আসার কথা নয় বলেই রক্ষা।
.
আগের দিনের মতই খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল যশোমতীর। পাশে রাজু শুয়ে, তাকে ঠেলে তুলল। তারপর মুখ হাত ধুয়ে দু’জনে চলল, বাগান পেরিয়ে পুকুরঘাটের দিকে। রাত্রিতেই রাজুর কাছে শুনেছিল, মামা মোজ ওই সময়ে পুকুরে চান করে।
শুধু এটুকু দেখার জন্যেই যে আসা, সেটা স্বীকার করতে যশোমতীর নিজের কাছেই লজ্জা।
আজকের দেখাটা আরো একটু সহজ হল। চান যে করছে তার যখন ভ্রূক্ষেপ নেই, সে মাঝখান থেকে লজ্জা পেতে যায় কেন। আজও মামা-ভাগ্নের ঘটা করে চান হল। যশোমতী দেখছে, হাসছে–তার ভালো লাগছে।
কিন্তু সেদিন আর সে ফ্যাক্টরিতে গেল না ইচ্ছে করেই। মিছিমিছি ভদ্রলোকের কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে লাভ কি। ফলে আবার দেখা সেই সন্ধ্যার পরে। হাব-ভাব দেখে যশোমতীর মনে হল গান শোনার ইচ্ছে। দিদি ইতিমধ্যে দুই-একবার গান গাইতে বলেছে, বিহারীও আশায় আশায় কাছেই ঘুরঘুর করছে। গান করার জন্য প্রস্তুতও ছিল বলতে গেলে। কিন্তু কি খেয়াল চাপল মাথায়, যশোমতী দিদিকে বলে বসল, আজ থাক, শরীরটা ভালো লাগছে না।
দিদি ব্যস্ত হয়ে উঠল, থাক তাহলে। কি খারাপ লাগছে, নতুন জায়গায় জ্বর-জ্বালা এলো না তো? বলে কপালে হাত ঠেকালো।–না গা তো ঠাণ্ডাই।
আর একটু পরেই দেখা গেল গম্ভীর মুখে শঙ্কর সারাভাই বেরিয়ে গেল। যশোমতীর তখনই অনুশোচনা হল একটু, গাইলে হত। কিন্তু মনে মনে কেন যেন খুশিও আবার।
পরদিন শঙ্কর সারাভাইকে চানের ঘাটে দেখা গেল বটে, কিন্তু চানের পর কারখানায় তার সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। বিহারীকেও দেখা গেল কারখানা ছেড়ে এদিকেই ঘোরাঘুরি করছে। দিদির কাছে যশোমতী শুনল, কাজ এ-রকম অনেক দিনই বন্ধ থাকে। কখনো সড়কের ছোটখাট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে যেতে হয় বলে, কখনো বা কাঁচা মালে টান পড়ে বলে। তাছাড়া, ভাতা কল বিগড়ানো তো আছেই। আজ কি জন্যে ফ্যাক্টরি বন্ধ দিদি সঠিক করে বলতে পারল না।
যতবার ফ্যাক্টরি শব্দটা শোনে অতোবারই হাসি পায় যশোমতীর। আবার দুঃখও হয়।
শঙ্কর বাইরে থেকে ফিরল সকাল সাড়ে নটা নাগাদ। রাজুকে নিয়ে যশোমতী দিদির কাছে বসে ছিল। দিদি চাল বাছছে, আর যশোমতী বই-সেট নিয়ে রাজুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে অক্ষর পরিচয়ের চেষ্টায় লেগেছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে আবার।
কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়, শঙ্কর সারাভাই যেন বাতাসেই খবর ছুড়ল, সে জেনে এসেছে প্রাইমারি স্কুল বন্ধ থাকলেও সেখানকার কর্তাব্যক্তিটি আজ আপিসে আসছেন, অতএব এক্ষুনি তার সঙ্গে বেরুলে দেখা হতে পারে এবং চাকরির সম্বন্ধে কথাবার্তা হতে পারে।
খানিক আগেই দিদি আশ্বাস দিচ্ছিল, ঠাকুরের দয়ায় কিছু একটা ব্যবস্থা শিগগীরই হয়ে যাবে। তাই শোনামাত্র তাড়া দিল, যাও যাও, তৈরি হয়ে নাও তাহলে। ভাইয়ের দিকে ফিরল, তুই নিয়ে যাবি তো?
শঙ্কর জবাব দিল না। এই নীরবতার অর্থ অনুকূলই মনে হল যশোমতীর। নতুন উৎসাহে রাজুর বই-স্লেট রেখে তাড়াতাড়ি সে ঘরে গিয়ে ঢুকল। নিজের সেই একমাত্র শাড়ি-ব্লাউজ বদলে নিতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। আর তারপরেই কি মনে পড়তে ধুপ করে চৌকিতে বসে পড়ল, এবং বসেই থাকল।
জুতো মাত্র এক পাটি।
তার দেরি দেখে দিদি ঘরে এলো, শঙ্করও দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। দিদি অবাক, কি হল, বসে আছ যে, যাবে না?
বিব্রত মুখে যশোমতী দরজার দিকে তাকালো একবার, তারপর বলল, স্যাণ্ডেলের আর-এক পাটি পাচ্ছি না।
সমস্যাটা যে এই মুহূর্তের নয় সেটা ফাঁস করার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু দিদি নিজেই তাড়াতাড়ি স্যাণ্ডেল খোঁজার উপক্রম করতে যশোমতীকে দ্বিধান্বিত মুখে আবার বলতে হল, পাওয়া যাবে না, প্রথম দিন স্যাণ্ডালজোড়া বাইরে ছিল, কুকুর-টুকুরে নিয়ে গেছে বোধহয় একটা–
সঙ্গে সঙ্গে বাইরের লোকটার মুখের যে পরিবর্তন দেখল, অন্যসময় হলে যশোমতী হয়তো তা উপভোগই করত। কিন্তু স্বার্থটা এখন তারই। তাই মনে হল, বিপদ যেন ষড়যন্ত্র করে একের পর এক এসে তার ওপর চড়াও হচ্ছে। এ-সময়ে এই গণ্ডগোলে পড়ার কোনো মানে হয়। ওদিকে দিদিও বিপন্ন মুখে ভাইয়ের দিকে চেয়ে আছে। অর্থাৎ কি করা যেতে পারে তাই জানতে চাইছে।
দিদির এই চাউনিটাই যেন রাগের কারণ শঙ্কর সারাভাইয়ের। সরোষে বলে উঠল, এক পা বুঝে চলার মুরোদ নেই, এ-সব মেয়ে বাড়ি থেকে বেয়োয় কেন। চাকরির চেষ্টায় বেরিয়ে আরো বিভ্রাট বাড়ানোর দরকার কি–ঘরে বসে থাকলেই তো পারে।
দিদি ঘরে না থাকলে যশোমতীরও পাল্টা রাগ হতে পারত, কিন্তু এখন অসহায় মুখটি করে দিদির দিকেই তাকালো সে। ফলে দিদি ব্যাপারটাকে সহজ করে নিতেই চেষ্টা করল, তোর যেমন কথা, রাগ করতে পারলেই হল–ওকি জানে, না গায়ে আর এসেছে কখনো ও কি করবে?