কলেজে ঢুকেও এই হিসেবের রাস্তাই ধরেছিল সে। কমার্স পড়েছে। পাঠগত ঐক্যে সেই প্রথম বিচ্ছেদ। তারপর কর্মের অধ্যায়ে সঙ্গবিচ্ছেদ। নিষ্ঠা সহকারে ত্রিপুরারি সেই হিসেবের রাস্তা ধরেই এগিয়েছে। এম. এ. কমার্স পাস করেছে, অ্যাকাউন্টস-এর আরো দুই একটা কি বাড়তি পরীক্ষাও দিয়েছে শুনেছিলাম। তাতেও ভালো করেছে। কিন্তু উপরওয়ালা অনেকদিন পর্যন্ত তার চাকরির ব্যাপারে হিসেবের গরমিল করেছেন। কোনটাই মনের মত হয় না। কর্মজীবনে নানা ঘাটের জল খেয়ে একসময় ওই কাপড়ের কলের দেশে গিয়ে স্থিতি হয়েছে সে। দু’তিন বছর অন্তর দেখাশুনা হয় ও কলকাতায় এলে। কোন্ এক কটন মিলের চিফ অ্যাকাউন্টেন্টের পোস্টে প্রমোশন পেয়েছে–ওর সম্পর্কে আমার শেষ খবর এইটুকু।
এই ত্রিপুরারির অপ্রত্যাশিত পত্রাঘাতে একটু অবাকই হয়েছিলাম। পত্র একটি নয়, পর পর কয়েকটি। সব ক’টারই সার মর্ম এক। আসা চাই। আসা চাই-ই চাই। না এলে ওর প্রেস্টিজের হানি। ফাস্ট ক্লাসের যাতায়াতের ভাড়া পাঠাতেও সে প্রস্তুত।
সেই কাঠখোট্টা চিঠির কোনো কোনো অংশ হাসি উদ্রেক করার মতো। লিখেছিল, আমাদের সাহিত্য-ফাহিত্যের কানাকড়ি দামও সে কোনো দিন দেয়নি। আজও এর মর্ম নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু এখন বুঝছে ঘামালে ভালো করত। অন্তত কখন কি লিখছি আমি, তার একটু-আধটু খবর রাখলেও মন্দ হত না। কারণ, জীবনের এই নতুন অভিজ্ঞায় সে দেখছে অকাজের কাজও কখন যে কত বড় হয়ে ওঠে তার ঠিক নেই। লিখেছে, আমার বোধহয় জানা নেই, যে বিশাল কটন মিলের সে চিফ, অ্যাকাউন্টেন্ট এখন, তার একেশ্বরী অধিশ্বরী এক রমণী। রমণীর সাহিত্যপ্রীতি সম্পর্কে বিশদ কোনো ধারণা ছিল না ত্রিপুরারির। এর থেকে যে এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তাও কখনো কল্পনা করেনি। সংস্কৃতির সর্ব ব্যাপারে মহিলাটির মোটামুটি এক ধরনের প্রীতির যোগ দেখে অভ্যস্ত সকলে। এটা বাইরের বস্তু বলেই ধরে নিয়েছিল ত্রিপুরারি। কারণ এতবড় কোম্পানীর যাবতীয় হিসেব দেখতে এবং বুঝে নিতে চেষ্টা করে যে মহিলা, সাহিত্য-টাহিত্য নিয়ে তার সময় নষ্ট করার মতো সময় আছে বলেই সে ভাবতে পারত না।
ত্রিপুরারির যত ফ্যাসাদ এই ভাবতে না পারার দরুন।
আসন্ন সম্মেলনের আগে কত্রীর ঘরে তার ডাক পড়েছিল মোটা অঙ্কের কিছু নগদ টাকা যোগানোর জন্য। মোটা অঙ্ক বলতে দু’দশ লাখ টাকার চেকও অনায়াসে মহিলা নিজেই কাটতে পারে। কিন্তু সচরাচর তা করে না। করে না তার কারণ সে বুদ্ধিমতী। গণ্যমান্য সমাবেশের খরচাটা যদি কোম্পানীর কোনোরকম প্রচারের খাতে চালিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে মোটা অঙ্কের আয়কর বাঁচে। ব্যাঙ্কের ব্যক্তিগত তহবিলও নড়চড় হয় না। এসব ব্যাপারে মহিলার পাকা মাথা অনেক সময় বিড়ম্বনার কারণ, অনেক সময় বিস্ময়ের।
কথা-প্রসঙ্গে এখানেই ছেলেবেলার পরিচিত বন্ধু হিসেবে আমার নামটাও সাত-পাঁচ না ভেবেই ছুঁড়ে দিয়েছিল ত্রিপুরারি। কত্রীর ঘরে বসে আরো কারা দু-চারজন চেনা-জানা সাহিত্যিকের নাম করছিল। কে আসতে পারে না পারে। মুখ খুলে এমন ফ্যাসাদে পড়বে ত্রিপুরারি ভাবতেও পারেনি। শোনামাত্র মহিলার আগ্রহ দেখে সে অবাক যেমন, বিব্রতও তেমনি। এক কথায়, আমাকে সম্মেলনে আনার দায়িত্ব ওর ঘাড়েই পড়েছে। এখন আনতে না পারলে ওর ঘাড় বাঁচে না। এর পরে দেখা হলেই কত্ৰী জিজ্ঞাস! করে, আপনার বন্ধু আসছেন তো?….অতএব, সম্মেলনের কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণের অপেক্ষায় আমি যেন বসে না থাকি। এ যাত্রায় ওর মুখরক্ষার ব্যবস্থাটা আমাকে করতেই হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখানে আসার পর অবশ্য এই বিশেষ আমন্ত্রণের আনন্দটুকু কিছুটা নিষ্প্রভ হয়েছিল। কারণ, শুনলাম মহিলার এ-ধরনের আগ্রহের নায়ক আমি একা নই। বাংলাদেশের যে সাহিত্যিক বা কবির নামই এই স্থানে একটু-আধটু, রচিত–তাকেই সম্মেলনে আনার জন্য কোনো না কোনো বিশেষ চেষ্টা করা হয়েছে। আসল উদ্দেশ্য, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি জমজমাট করে তোলা। বিশেষ আমন্ত্রণ ব্যবস্থায় লেখকরা অনেকেই আমার মতে পরিতুষ্ট দেখলাম। অতএব নিজেকে বিশেষ ম্মানিত ব্যক্তি মনে করার খুব কারণ নেই।
স্টেশনে নিতে এসেই ত্রিপুরারি ঠাস ঠাস কথা শুনিয়েছে। সে কথা থেকে ওর বক্তব্য উদ্ধার করা সহজ নয়। দুটো প্রেমের গল্প বাতাসে ছেড়ে দিয়ে কি মজাই লুটছ বাবা তোমরা, এমন জানলে কোন্ শালা অ্যাকাউন্ট নিয়ে মাথা খুড়ত! মাঝবয়সে এখন সাহিত্যের পিছনে ছোটাছুটি–
-ছোটাছুটি কি রকম? আমি ঘাবড়েই গেলাম, তুমি সাহিত্য চর্চা শুরু করেছ নাকি?
অবাঙালী ড্রাইভারকে ওর বাড়ির দিকে চালাতে নির্দেশ দিয়ে ভুরু কুঁচকে ঘুরে বসল।–শুরু করেছি মানে? একের পর এক শেষ করছি। প্রথম তিন পাতা, মাঝের তিন পাতা, আর শেষের তিন পাতা। একদিনে একখানা বই তিনবারে ফিনিস। গেল এক মাসে কম করে তোমার দশখানা বই লাইব্রেরি থেকে ইস্যু করতে হয়েছে, জানো?
হেসে বাঁচি না।—সে কি হে! তোমাকে এ-রকম শাস্তির মধ্যে কে ফেললে?
–হাসো, খুব হেসে নাও, বে-কায়দায় পড়লে সকলেই হাসে–বউও হেসেছে। আমার হাতে নভেল দেখে তো প্রথমে ভয়ই পেয়েছিল, ভেবেছিল মাথাটাই বুঝি গেছে খারাপ হয়ে। চোখ-কান বুজে তোমার সব থেকে গাবদা রাবিশ বইটাকে পর্যন্ত খতম করেছি, জানো?