দিদি চলে গেল। শঙ্কর সারাভাই তখনো ভেবে পেল না, মাত্র একদিনের পরিচয়ের এক বিপদগ্রস্ত অজানা মেয়ে দিদির এরকম আপন হয়ে গেল কি করে। দু-চার মুহূর্ত আবার তাকে নিরীক্ষণ করে কাজের দিকে এগিয়ে গেল সে।
যশোমতী বিব্রত বোধ করছে বটে, আবার পরিস্থিতিগুণে মজাও পাচ্ছে। রাজুর হাত ধরে পায়ে পায়ে সে-ও সেদিকে এগলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাজের বহর দেখল একটু সে-যে আবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ্য করেও করছে না। অতএব যশোমতী তাকে ডেকেই বলল, শুনুন, এভাবে আপনাদের ঘাড়ের ওপর বসে থাকার ইচ্ছে সত্যিই আমার নেই–যদি সরাতে চান তো আগে আমার একটা কাজের যোগাড় করে দিন। যে-ভাবে চলে এসেছি, বাড়ি ফের সত্যিই আর এখন সম্ভব নয়। আর, আপনাকে একটা কথা বলছি, ঋণ রাখার আমার অভ্যেস নেই, আপনারা যা করেছেন সেটা অবশ্য শোধ করা যাবে না কিন্তু টাকার ঋণ থাকবে না, আপনি নিশ্চিন্ত হোন।
টাকার প্রসঙ্গ উঠতে শঙ্কর উষ্ণ হয়ে উঠল, কারণ, এটা সে ঠেস বলেই ধরে নিল। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। তার আগেই রাজুর হাত ধরে মন্থর পায়ে প্রস্থান করল যশোমতী। কাজ ফেলে শঙ্কর সারাভাই সেদিকে চেয়েই রইল। মেয়েটির কথাবার্তা হাব ভাব, আচরণ সবই অদ্ভুত লাগছে তার। ইচ্ছে থাকলেও খুব যেন অবজ্ঞা করা যায় না। এম. এ. পরীক্ষা দেবার কথা ছিল শোনার পর আরো ধাঁধায় পড়ে গেছে সে। অনার্স নিয়ে বি. এ. পাস করার পর শহর ছেড়ে চাকরির খোঁজে এ-রকম একটা জায়গায় আসবে কেন! হতে পারে দাদার কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়, তাহলেও মেয়েদের হাইস্কুল তো অনেক জায়গাতেই আছে, তার বদলে এলো প্রাইমারি স্কুলের চাকরির চেষ্টায়।
শঙ্করের সবই দুর্বোধ্য লাগছে।
কাজে আর মন বসল না। জোরালো আলোর অভাবে ভালো করে বিকেল না হতে এখানকার আলোয় টান ধরে। বিহারীকে সব গুছিয়ে রাখতে বলে সাবান হাতে পুকুর ধারে চলে এলো। মুখ-হাত ভালো করে ধুয়ে ঘরে ফিরল। রাজুর বা তার ভুইফেঁড় মাসির কাউকে এদিকে দেখল না। জামা-কাপড় বদলে বেরিয়ে পড়ল সে। দুই একজনের সঙ্গে দেখা করে, লাভের অংশ দিয়েও যদি কিছু টাকা আনতে পারে।
সুরাহা হল না। টাকা দেবার নামেই মাথায় আকাশ ভাঙে সকলের। তবু সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরল যখন, একজোড়া শাড়ি হাতে করেই ফিরল। কিন্তু দাওয়ায় ঢোকার আগেই গান কানে এসেছে। ভক্তিমূলক গান। শঙ্কর দাঁড়িয়ে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনল। ব্যবসা নিয়ে নাকানিচোবানি খাবার পর থেকে মন দিয়ে একটা আস্ত গানও কখনো শুনেছে কিনা সন্দেহ। সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর এই গান যেন স্নায়ু-জুড়ানো স্পর্শের মতো। এই অনুভূতিটা নতুন। দিদির অনুরোধেই আর একখানা গানও হল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শঙ্কর সেটাও শুনল।
তারপর ভিতরে এসে দাঁড়াল। ঘরের বাইরের দাওয়ায় বসে গান হচ্ছিল। শুধু দিদি আর রাজু নয়, সমঝদার শ্রোতার মতো অদূরে বিহারীও বসে গেছে।
তাকে দেখে দিদি বলল, তুই তো একবারও শুনলি না, আহা, বোনের আমার খাসা মিষ্টি গলা, আর কি দরদ! ওকে একখানা শোনাও না।
যশোমতী হাসিমুখেই অনুরোধ নাকচ করে দিল, বলল, গান সকলের ভালো লাগে না দিদি, আজ থাক্।
ওদিক থেকে বিহারী উঠে দাঁড়িয়ে মন্তব্য করল, দাদাভাই ছেলে বেলায় খুব গলা ছেড়ে গান করত, আধমাইল দূর থেকে শোনা যেত। বড় হয়ে গান ভুলেছে।
দিদি হেসে উঠল।–সত্যি, কি গানই করত, কান ঝালাপালা। কাপড় আনলি?
পুঁটলিটা দিদির হাতে দিয়ে শঙ্কর চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেল। দিদি সেটা খুলে হারিকেনের স্বল্প আলোয় শাড়ি-জোড়া আগে পরখ করে নিল, রাগের মাথায় কি এনে হাজির করেছে সেই সংশয়। দেখে অপচ্ছন্দ হল না। শাড়ি জোড়া যশোমতীর দিকে এগিয়ে দিল।–নাও।
রাজ্যের সঙ্কোচ আবার। তবু হাত বাড়িয়ে নিতে হল শাড়ি জোড়া। না নিয়েই বা করবে কি। কিন্তু নেবার সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞাত রোমাঞ্চকর অনুভূতি কি একটা। জীবনে পাওয়ার দিকটা তার এত প্রশস্ত যে সামান্য দু’খানা আটপৌরে শাড়ি হাতে নেবার এই প্রতিক্রিয়া নিজের কাছেই বিস্ময়কর।
ঘরে বসে ভাবছে যশোমতী। কপাল-গুণে একটা ভালো জায়গাতেই সে এসে পড়েছে। কিন্তু বাড়ি-ঘর ছেড়ে এসে মাঝখান থেকে এই জায়গায় সে আঁকড়ে পড়ে থাকবে? কি করবে? চাকরি পেলেই বা থাকবে কোথায়?
-লীলা, খেতে এসো। ওদিক থেকে দিদির গলা কানে এলো।
যশোমতী আবারও খেয়াল করল না যে এখানে সে লীলা হয়ে বসেছে।….ভাবছে দুপুরের দিকে ওদিকের কোন্ বাড়ির বউ এসেছিল–যার কাছ থেকে শাড়ি ধার করা হয়েছিল। শাড়ি চেয়ে পাঠানোর ফলেই আসার কৌতূহল হয়েছিল কিনা কে জানে। যশোমতীকে দেখে অবাকই হয়েছিল বউটি, জিজ্ঞাসা করেছিল, কে। দিদি তার সামনেই চট করে পরিচয় দিয়েছিল, তাদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয়। স্কুলে চাকরির চেষ্টায় এসেছে–
কিন্তু আত্মীয় হলেও বা চাকরির চেষ্টায় এলেও এক, শাড়ি নিয়ে কেউ এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় আসে কেমন করে তাই বউটির কাছে খুব স্পষ্ট হয় নি।
-লীলা, খাবে এসো।
দিদির দ্বিতীয়বারের ডাকও কানে গেছে। কিন্তু সেই-ই যে লীলা, এই ভাবনার মধ্যে পড়ে এবারেও সচেতন হল না। নিজের এলোমেলো চিন্তায় তন্ময় সে।….গত রাত্রিতে এই ঘরে একা থাকতে তার কেমন ভয়-ভয় করছিল। আজ ভাবছে দিদিকে বলে রাজুকে এ ঘরে নিয়ে আসবে কি না। তাছাড়া আর একটা কথা ভেবেও তার সঙ্কোচ হচ্ছে। ওই ভদ্রলোকের ঘর এটা, সে ঘর দখল করার ফলে ঘরের মালিককে তার ফ্যাক্টরির ঘরে বিহারীর সঙ্গে জায়গা করে নিতে হয়েছে। কিন্তু দিদির ঘরে গিয়ে ভাগাভাগি করে থাকতেও মন সায় দেয় না। কি করবে যশোমতী?