তিনটাকা দু আনাকে ইচ্ছে করেই ছ’ আনা আট আনায় দাঁড় করালো যশোমতী। আর হাতে-নাতে প্রত্যাশিত ফলও পেল। কক্ষ জবাব শুনল, কৃতজ্ঞতাবোধ থাকলে ওইটুকুর জন্যেই কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আপনি মস্ত বড়লোক বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার কাছে ওই ছ’আনা আট আনারই অনেক দাম, বুঝলেন?
দুই ঠোঁটে হাসি চেপে মুখখানা যতখানি নিরীহ করে তোলা যায় সেই চেষ্টাই করছে যশোমতী। গতকাল বাস থেকে এ পর্যন্ত তিরিশ ঘণ্টা পার হয় নি, তবু এরকম বিচিত্র যোগাযোগের ফলেই হয়তো অনেক স্বাভাবিক সঙ্কোচ অনায়াসে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে সে। পরিবেশ গুণে আর লোকটার মেজাজের গুণেও হয়তো সহজ হওয়া আরো সহজ হয়েছে। অম্লানবদনে বলে বসল, কিন্তু সেও তো আপনার নিজের নয়, কোন আত্মীয়ের কাছ থেকে ভাওতা দিয়ে টাকা এনেছেন শুনলাম।
ব্যস, মামার এই মূর্তি দেখে ক্ষুদ্র ভাগ্নেটি পর্যন্ত মনে মনে শঙ্কিত। শঙ্কর সারাভাইয়ের গম্ভীর দৃষ্টি অদূরবর্তিনীর মুখের ওপর কেটে বসল যেন।—এরকম বলার মতো পরিচয় আপনার সঙ্গে আমার এখনো হয় নি বোধহয়।
যশোমতী ভয় পেয়েই মাথা নাড়ল যেন। বলল, না এখনো হয় নি। এখনো কথাটার ওপর সামান্য একটু জোরও পড়ল।
শঙ্কর সারাভাইয়ের মেজাজ ঠিক রাখা শক্তই হয়ে উঠছে। খুব স্পষ্ট করে যশোমতীর কর্তব্য বুঝিয়ে দিল সে।–তাহলে আপনি দয়া করে এসব কথা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, নিজের ব্যবস্থাটা যত তাড়াতাড়ি হয় সেই চিন্তা করুন গে।
যশোমতী এবারও মাথা নাড়ল, অর্থাৎ তাই করবে। কষ্ট গাম্ভীর্যে তাকে লক্ষ্য করে ভদ্রলোক কাজের দিকে পা বাড়াবার উদ্যোগ করতেই যশোমতী আবার বাধা দিল, কিন্তু একজন বিপন্ন মহিলার সঙ্গে আপনিও তো ভালো ব্যবহার করছেন না। শঙ্করণ সারাভাইর সপ্রশ্ন চোখে চোখ রেখে গম্ভীর মুখে বলল, দিদির কাছে শুনলাম এখানে নাকি গানের স্কুলও হবে একটা আর প্রাইমারি স্কুল হাইস্কুল হয়ে যাবে–এ-সব খবর আপনি বলেন নি তো।
-হাইস্কুল হবে তাতে কি?
–হলে প্রাইমারিতে ঢুকব কেন?
জবাবে শঙ্কর সারাভাই ঠেস দিয়ে বলল, হাইস্কুলে চাকরি করতে হলে কোয়ালিফিকেশনও একটু হাই হওয়া দরকার, বুঝলেন? প্রাইমারির কোয়ালিফিকেশনে হয় না–
–কি রকম হাই হওয়া দরকার, ডক্টরেট-টক্টরেট?
বিরক্তি সত্ত্বেও কথার ধরনে কেমন খটকা লাগল শঙ্করের। এ যেন ঠিক সামান্য পড়াশুনা করা মেয়ের উক্তি নয়। ফিরে আবার দেখল একটু।–আপনি কি পাস?
–আপনার থেকে একটু বেশিই হবে–ফিলসফি অনার্স নিয়ে বি. এ. পাস করেছিলাম, এবারে এম. এ. দেবার কথা ছিল। এতে হাই স্কুলের চাকরি হবে না?
বিশ্বাস করবে কি করবে না শঙ্কর সারাভাই ভেবে পেল না কয়েক মুহূর্ত। খোঁচা খেয়েও মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। সেই অবকাশে দিদির আবির্ভাব। যশোমতী সচকিত। ওদিকে মাকে দেখামাত্র রাজু মামার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করল, মা মাসির সঙ্গে মামা ঝগড়া করছিল।
ঠোঁটের ফাঁকে হাসি এসেই গেল এবারে যশোমতীর। আর রাগতে গিয়ে শঙ্করও হেসে ফেলল। ওদিকে দিদি দুজনকেই নিরীক্ষণ করল একবার। তার কেমন একটা সন্দেহ হয়েছিল, ভাই আগে থেকেই হয়তো বা চেনে এই মেয়েকে, তাই বিপদে পড়েছে শুনে একেবারে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। ঝগড়ার কথা শুনে সন্দেহটা আরো পাকা হল।
হেসে বলল, তোরই তো মামা, ঝগড়া করবে না? কি হয়েছে?
প্রশ্নটা যশোমতীর দিকে চেয়ে। যশোমতী হাসিমুখেই মাথা নাড়ল, কিছু হয় নি। শঙ্কর ভাগ্নের উদ্দেশে চোখ পাকালো, এই পাজী, কি ঝগড়া করেছি?
দিদি মন্তব্য করল, বলেছিস কিছু নিশ্চয়, নয়তে ও বলবে কেন? ভালো কথা, যা বলতে এলাম–তোর কাজ শেষ হয়েছে না হয় নি?
-কেন? শঙ্কর সন্দিগ্ধ।
–একবার বাজারে বেরুতে হবে না? লীলার জন্যে একজোড়া শাড়ি কিনে নিয়ে আয়, ওই একখানা শাড়িতেই চলবে নাকি, তাও ভালো শাড়ি–লোকের সঙ্গে দেখাশুনা করার জন্যেও ওটা তুলে রাখা দরকার। বাড়িতে পরার জন্য তুই একজোড়া কিনে নিয়ে আয়, তারপর তোর সময়মতো নিজে হাতে আর একজোড়া ভালো শাড়ি বানিয়ে দিস। বক্তব্য শেষ করে দিদি যশোমতীর দিকে ফিরল। ভাইয়ের প্রশংসা করতেও কার্পণ্য করল না। বলল, ইচ্ছে করলে ও নিজেই খুব ভালো শাড়ি বানাতে পারে, দেখবে’খন–
সে-ই যে লীলা নিজেরই খেয়াল ছিল না। খেয়াল হতে সঙ্কোচে আড়ষ্ট। আর দিদির কথা শোনার পর যে মুখ হল। ভদ্রলোকের, তাও দেখার মতই।
শঙ্কর সারাভাই আকাশ থেকেই পড়ল বুঝি। চিরাচরিত অনুভূতিটা সামলে নিতে সময় লাগল একটু। গম্ভীর মুখে একবার যশোমতীর দিকে তাকিয়ে দিদির মুখোমুখি হল সে। –দু’ জোড়া মানে চারটে শাড়ি লাগবে? তা কত দিনের ব্যবস্থা?
ভাইয়ের মেজাজ তেতেছে বুঝেছে, কিন্তু বক্তব্যটা কি দিদির ঠিক বোধগম্য হল না। জিজ্ঞাসা করল, কি বলছিস?
–বলছি, উনি কতদিন থাকবেন এখানে?
এ ধরনের উক্তির সঙ্গে দিদি পরিচিত। কিন্তু ইচ্ছে করেই অর্থাৎ সব জেনে-শুনেও মেয়েটাকে লজ্জা দিচ্ছে ভেবে বিরক্তও। বলল, তোর যেমন কথার ছিরি, কাজের চেষ্টায় নিয়ে এলি আর ভালো রকম চেষ্টা-চরিত্র না করেই ওই দাদার বাড়িতে ফিরে যাবে আবার! নাকি গেলে ওই দাদা এরপর আর একটুও ভালো ব্যবহার করবে ওর সঙ্গে। ব্যবস্থার কথা তোকে কিছু ভাবতে হবে না, লীলার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে-তোকে যা বললাম, কর, টাকা আমিই দেব’খন, খরচের কথা শুনলেই তোর ভদ্রতাজ্ঞান পর্যন্ত থাকে না।