দিদি যে মুখ করেই বলুক, ভাইয়ের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এই চেষ্টাটাকে খুব ছোট করে দেখে বলে মনে হল না। বলা বাহুল্য, যশোমতীর ভালো লেগেছে, সবটুকুই কান পেতে শুনেছে। গত রাত্রিতেও লোকটার শিক্ষা-দীক্ষা আছে কিনা সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল তার।
কৌতূহল দমন করতে না পেরে দুপুরে রাজুর হাত ধরে ফ্যাক্টরি দেখতে চলল সে। দুপুরে মানুষটা খেতেও আসে নি, বিহারী তার খাবার নিয়ে গেছে ওখানে। শুনেছে, কাজে মন দিলে এই রকমই নাকি হয়।
ফ্যাক্টরি বলতে টিনের শেড দেওয়া ওই জায়গাটুকুই। কাপড় বানানোর ব্যবসা শুনেই যশোমতীর আরো বেশি কৌতূহল হয়েছিল। কিন্তু ভিতরের দশা দেখে তার চক্ষুস্থির। বাবার যে বিশাল মিল দেখে সে অভ্যস্ত সেই চোখে এটা দেখে তার হেসে সারা হওয়ার কথা। যশোমতী হেসেই ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু তারপরেই তার দুঃখই হল একটু। এমন করেও কেউ অনর্থক উদ্যম নষ্ট করে।
শঙ্কর সারাভাই একবার দেখল তাকে। কিন্তু ভালো করে তাকানোর ফুরসত নেই। সে তখন কাজে ব্যস্ত। সর্বাঙ্গ দর-দর করে ঘামছে। গায়ে হাত-কাটা গেঞ্জি, পরনে আধময়লা পা-জামা। সে একাই মালিক আর একাই প্রধান শ্রমিক। সাহায্যের জন্য আছে পুরানো সাগরেদ বিহারী।
যশোমতী দেখছে চেয়ে চেয়ে। তার বাবার কলে শ’য়ে শ’য়ে লোক খাটতে দেখেছে। কিন্তু মেহনতী মানুষের এই মূর্তি সে যেন আর দেখে নি। পাওয়ার মেশিন চলছে, ভারী ভারী সরঞ্জাম নিজেই টেনে টেনে তুলছে, পরিপুষ্ট দুই বাহুর পেশীগুলো লোহার মত উঁচিয়ে উঠছে এক-একবার।
আর নিষ্পলক চোখে পুরুষের রূপ দেখছে যশোমতী। কাজের সময় ক্ষুদ্রকায় চঞ্চল ভাগ্নেটি পর্যন্ত চুপ! এ সময় বিরক্ত করা চলবে না, মামা তাহলে রেগে যায়–সে-সম্বন্ধে যশোমতীকে সে আগেই সতর্ক করে রেখেছিল। কলের মূর্তির মতো মুখ বুজে এটাসেটা এগিয়ে দিচ্ছে বিহারী।
অনেকক্ষণ বাদে হয়তো একটু বিশ্রাম নেবার জন্যই গামছায় ঘাম মুছতে মুছতে শঙ্কর সারাভাই নিস্পৃহ মুখে যশোমতীর সামনে এসে দাঁড়াল। হাতল-ভাঙা একটা কাঠের চেয়ার দেখিয়ে বলল, বসুন। বসার মত ঘরে আর দ্বিতীয় কিছু নেই।
যশোমতী বসল না, হাসিমুখে চেয়ারটার গায়ে একটু ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। ফ্যাক্টরি প্রসঙ্গে দুটো প্রশংসার কথা বললে হয়তো খুশি হবে, কিন্তু বলার মতো কিছু মাথায় এলো না। সে-চেষ্টার আগেই ভাগ্নেটি একটা সুসমাচার জ্ঞাপন করল মামাকে। সোৎসাহে বলে উঠল, মামা, মাসি বলেছে আমাকে একটা সত্যিকারের কলের মোটরগাড়ি কিনে দেবে আর একটা সত্যিকারের তিন চাকার সাইকেল কিনে দেবে!
গেল বছর মায়ের সঙ্গে সাবরমতীর দেব-উঠি-আগিয়ারস্-এর মেলায় গিয়ে সেই বড় শহরের দোকানে এই দুটি দুর্লভ জিনিস দেখার পর দুনিয়ায় এর থেকে বেশি কাম্য জিনিস আর কিছু নেই মনে হয়েছে রাজুর। অন্তরঙ্গ আলাপের ফাঁকে সেটা বোঝামাত্র অবস্থা ভুলে যশোমতী তাকে কথা দিয়ে বসেছিল ওই দুটো জিনিসই কিনে দেবে।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সমাচারটা বেখাপ্পা শোনালো। আরো বেখাপ্পা শোনালো এই জন্যে যে, ভাগ্নের আনন্দ দেখে মামাটি যে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকালো যশোমতীর দিকে, তার অর্থ, সে যেন এই হাস্যকর ব্যবসাকে বড় মিলে দাঁড় করানোর থেকেও অসম্ভব কিছু আশ্বাস দিয়েছে ওই শিশুকে। এখানে এসব কথা নিয়ে উৎসাহ বোধ করার সময় কম তার। তবু টিপ্পনীর সুরেই জিজ্ঞাসা করল, সকালে স্কুলে দেখা করতে না গিয়ে বেশ গানটান করলেন শুনলাম।
একে ভাগ্নের আনন্দ-সমাচারের জবাবে ওই চাউনি, তারপর এই উক্তি। শোনামাত্র যশোমতীর ভিতরটা চিড়বিড় করে উঠল। আবার হাসিও পেয়ে গেল পরমুহূর্তে। ভদ্রলোকের অন্য রকম ভাবা অন্যায়, কিছু নয়। তবু হালকা জবাব দেবার লোভ ছাড়া গেল না। গম্ভীর সে-ও। বলল, দিদি আমার গানের খুব প্রশংসা করছিলেন, আর ওই বিহারীরও খুব ভালো লেগেছে। আপনি তো শুনলেন না–
শঙ্করের ভালো লাগার কথা নয়, ভালো লাগলও না। মন আপাতত নানা চিন্তায় আচ্ছন্ন। মেসোর কাছ থেকে যে টাকা এনেছে তার অনেকটাই অবশিষ্ট আছে এখনো। কাজের মধ্যেও তাই সকাল থেকে নতুন চেষ্টার ছক কাটছিল মনে মনে। যা ভাবছে তা করতে হলেও এ-টাকার কম করে বিশগুণ দরকার। তার ভগ্নাংশও পাওয়ার আশা দুরাশা। তবু মাথা খাঁটিয়ে এই টাকা দিয়েই আরো টাকা আনা যায় কিনা সেই অসম্ভব চিন্তাই তার মাথায় ঘুরঘুর করছে কেবল। তাই যশোমতীর কথায় কান গেল বটে, মন গেল না।
হালকা উক্তির কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে যশোমতী আর এক ধাপ এগলো। –স্কুলেই বা দেখা করতে যাই কি করে, কোথায় কি, আমি কিছু চিনি না জানি? সমস্ত দিনের মধ্যে আপনার তো দেখাই পাওয়া গেল না।
–তা আমি কি করব?
–দিদি বলছিলেন, আপনার চেনা-জানা আছে, যখন হয় আপনি নিয়ে যাবেন।
আমি? আমি এখন আপনাকে নিয়ে নিয়ে চাকরির জন্যে ঘুরব? আমার খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই!
-কি কাজ?
শঙ্কর সারাভাই নিজের মধ্যে ফিরে এলো এতক্ষণে। অর্থাৎ পিত্তি জ্বলার উপক্রম হল তার। গম্ভীর মুখে জবাব দিল, দিদির মাথা খারাপ হয়েছে। যা পারেন নিজে করুন গে, আমার দ্বারা আর কিছু হবে না, বুঝলেন? যথেষ্ট হয়েছে–
তার প্রতি পুরুষের এরকম নিস্পৃহতা এই বোধ করি প্রথম দেখছে যশোমতী। দিদির সঙ্গে সমস্ত সকাল গল্প করে মেজাজ কেন যেন অতিরিক্ত প্রসন্ন তার। এখনো কৌতুকই বোধ করল। ভালো মুখ করে বলল, কি যথেষ্ট হয়েছে? হবার মধ্যে তো আপনার দশ পয়সা বাসভাড়া খরচা হয়েছে আর ছ’আনা না আট আনা ট্রেনের টিকিট ভাড়া–