দিদি তার মুখের দিকে চেয়ে চুপচাপ শুনল। গায়ের গয়না লক্ষ্য করল। হাত দিয়ে হীরে-বসানন বালা দুটো নেড়েচেড়ে দেখল একটু। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তোমার বাবা খুব বড় অবস্থার লোক ছিল বুঝি?
ছিল শুনে যশোমতীর ভিতরটা খচ করে উঠল, ঢোঁক গিলে মাথা নাড়ল।
দিদি আবার বলল, এসব গয়না একখানাও কেনার লোক নেই এখানে। বিক্রি করতে হলে ট্রেনে চেপে ফিরে আবার শহরেই যেতে হবে। কিন্তু বাবার দেওয়া জিনিস তুমি বিক্রিই বা করতে চাও কেন? যে ক’দিন দরকার এখানেই থেকে চাকরির চেষ্টা করো, অবশ্য আমাদের এই গরীবের ঘরে তোমার খুব কষ্ট হবে।
যশোমতী তাড়াতাড়ি বাধা দিল, ওকথা বার বার বললে আমাকে চলেই যেতে হবে দিদি, আমি যে অবস্থায় পড়েছি তার তুলনায় এ তো স্বর্গ।
দিদিটি মনে মনে খুশি হল। এরই মধ্যে একটা অভিলাষ তার মনে উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে সেটা আর কেউ জানে না। ধীরে সুস্থে তার আগে অনেক কিছু জানার আছে, খুটিয়ে জিজ্ঞাসা করার আছে।….হয় যদি ছোঁড়ার ভাগ্য। বলল, তাহলে আর কি, তুমি নিশ্চিন্ত মনে চাকরির চেষ্টা দেখো, তারপর শঙ্করের সঙ্গে পরামর্শ করে যা-হোক একটা ব্যবস্থা করা যাবে, আর তোমার কি লাগবে তুমি আমাকে বোলো, বিহারীকে দিয়ে আনিয়ে দেব–তোমার হাতে টাকা এলে তখন শোধ করে দিও।
যশোমতী মাথা নাড়ল বটে, কিন্তু ব্যবস্থাটা মনঃপূত হল না খুব। টাকা কিছু হাতে এলে খরচ-বাবদ জোর করে দিদির হাতে কিছু গুঁজে দিতে পারত। তাহলে ওই একটা লোকের কাছে অন্তত সম্মান বাঁচে। আত্মীয়ের কাছ থেকে যেভাবে ধাপ্পা দিয়ে টাকা সংগ্রহ করেছে শুনলো গত রাত্রিতে, তাতে ভাগ বসাবার রুচিও নেই ইচ্ছেও নেই। যার কাছে টাকার এত দাম, কোনো একসময় তাকে দিয়েই গয়না বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারবে ভেবে তখনকার মতো এ নিয়ে আর কথা বাড়ালো না যশোমতী।
মুখ কাঁচুমাচু করে পরের সমস্যার সম্মুখীন হল সে। বলল, কিন্তু আজই স্কুলে দেখা করতে যাব? ….শরীরটা তেমন ভালো লাগছে না।
-তাহলে যেও না, আজই ছুটতে হবে তোমাকে কে বলেছে? স্কুলের লোকের সঙ্গে শঙ্করের আলাপও আছে, সে-ই না হয় তোমাকে নিয়ে যাবে’খন।
কিন্তু না গেলে শঙ্করবাবু যদি রাগ করেন?
ওর রাগের কথা ছেড়ে দাও, ওর রাগ আর রাজুর রাগ একরকমই।
বসে দিদিটির সঙ্গে গল্পে গল্পে আরো কিছু খবর জানা গেল এরপর। ফলে যশোমতীর আশা বাড়ল, কিছু সঙ্কোচও দূর হল। যেমন, মেয়েদের প্রাইমারী স্কুলটাকে হাইস্কুল করার চেষ্টা হচ্ছে। হয়ে যাবে হয়তো শিগগীরই। অনেকে এ-জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। আর ছোটখাট গানের স্কুলও আছে এখানে একটা-সেটাকে বড় করে তোলার খুব তোড়জোড় চলছে, কারণ, এই দেশে তো গানের ভক্ত বলতে গেলে সবাই। কে একজন নাকি মোটা টাকা দেবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। দিদির অবশ্য ও-সব গান খুব ভালো লাগে না, দুই-একটা ঠাকুর-দেবতার গান শুনলে বরং কান জুড়োয়।
যশোমতী ভালো করে বুঝে নিয়েছে, এই দিদিটিকে হাত করতে পারলে তার অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। অতএব সেই চেষ্টাই সর্বাগ্রগণ্য মনে হল তার। তক্ষুনি সবিনয়ে প্রস্তাব করল, আমি কিছু কিছু জানি দিদি, ঠাকুরের নাম করব একটু?
দিদি তাকালো আর সানন্দে মাথা নাড়ল। গলা না ছেড়েই একখানা ভজন গাইল যশোমতী। দরদ দিয়েই গাইল। গান শেষ হতে দিদি হাঁ, ক্ষুদ্র রাজু হ্যাঁ–আর অদূরে দাঁড়িয়ে বিহারী চাকরও মুগ্ধ। দিদি তো পারলে জড়িয়েই ধরে তাকে, বলল, আ-হা, এমন গুণের মেয়েকে কিনা চাকরির জন্যে ঘর ছেড়ে বেরুতে হয়েছে তোমার দাদা মানুষ না কি!
গোবেচারী মুখ করে বসে রইল যশোমতী। দিদিটির মন দখলের ব্যাপারে আর একটা বড় ধাপ উত্তীর্ণ হওয়া গেল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। অতঃপর দিদির গল্প শোনায় মন দিল সে। এই জমি-জমা আর ঘরের মালিক দিদি নিজে। তার জমিতে ওই ফ্যাক্টরির ঘরটা শুধু শঙ্করের তোলা। এই সবই দিদির স্বামীর ছিল। জমি যা আছে তাই থেকে বছরের ধান এসে যায়, আর বাগানের তরি-তরকারী তো আছেই। কাজেই খাওয়ার ভাবনা তাদের খুব নেই।
শুনে মস্ত একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল যশোমতী। এক অপ্রিয় প্রসঙ্গও মনে পড়েছে তক্ষুনি। মনে হয়েছে আত্মীয়ের কাছ থেকে লোকটার ধাপ্পা দিয়ে টাকা আনার কারণ তাহলে নিছক অনটনের দরুন নয়। আসলে স্বভাব আর টাকার লোভ। সকালে চানের ঘাটে যে দৃশ্য মিষ্টি অনুভূতির মতো মনে লেগে ছিল, তার ওপর বিরূপ ছায়া পড়-পড় হল একটা।
নিজের গল্প থেকে ক্রমে ভাইয়ের অর্থাৎ শঙ্কর সারাভাইয়ের প্রসঙ্গের দিকে ঘুরল দিদি। আর সেই বিরূপ ছায়াটা নিজের অগোচরেই সরে যেতে লাগল যশোমতীর মন থেকে। দিদির কথার সারমর্ম, ওই ভাইকে নিয়েই হয়েছে তার জ্বালা। এক দিদি ভিন্ন তাকে সামলাতে পারে এমন কেউ নেই। বি. এসসি, ভালো পাস করেছে, ভালো মাথা–ইচ্ছে করলেই একটা ভালো চাকরি করে সুখে থাকতে পারত, মেসো তো কতবার চাকরি নিয়ে সাধাসাধি করেছে– কোন্ এক মস্ত কাপড়ের কলে বড় চাকরি করে মেসোতা ছেলে গোলামী করবে না কারো। আর যে মেজাজ, চাকরি করবে কি করে। নিজের নড়বড়ে ব্যবসা নিয়ে মেতে আছে, তিনদিন চলে তো চারদিন সব বন্ধ থাকে। একটু ভালো অর্ডার হাতে এলেই কি করে টাকা যোগাড় করবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে। মূলধন না থাকলে অর্ডার পেলেই তো আর সাপ্লাই করা যায় না। তখন আর ভালো-মন্দ জ্ঞান থাকে না। ব্যবসা করে বড় হবে দিন-রাত খালি এই স্বপ্ন দেখে। বাবার আমলে উড়নচণ্ডী ছেলে ছিল, কিন্তু ব্যবসা শুরু করার পর থেকে একটা পয়সাকে সোনার চোখে দেখে।