এত সমস্যার ওপর সকালে উঠেই এই সমস্যা কার ভালো লাগে? আশায় আশায় তবু উঠোনে নেমেও নিঃশব্দে এদিক-ওদিক খানিক খোঁজাখুজি করল যশোমতী। উঠোনের বাইরেটাও একটু দেখল। তারপর হতাশ হয়ে ওই একপাটি স্যাণ্ডাল চৌকির আড়ালে এক কোণে পা মোছার ছালা দিয়ে নিরাপদে চাপা দিয়ে রাখল। যদি আর এক পাটির হদিস মেলে ভালো, নইলে যা গেছে তো গেছেই, আবার সেটা নিয়ে অপ্রস্তুত না হতে হয় সেই শঙ্কা।
পায়ে পায়ে বাইরে এলো। উঠোনের ওধারটায় বাগান। যশোমতী বাগানের দিকে এগুলো। সুন্দর তাজা আনাজের বাগান। বাগানে অনেক রকমের আনাজ হয়ে আছে। যা খায়, তা গাছে ফলে জানত, কিন্তু গাছের জিনিস দেখতে যে এত ভালো লাগে জানত না। বাগানের কেনা জিনিসের এক চেহারা, এগুলোর আর এক। ওধারে বাঁধানো পুকুর একটা। আরো ভালো লাগত পায়ে স্যাশ্যাল নেই ভূলে যশোমতী তাড়াতাড়ি সেদিকে এগুলো।
কিন্তু একটু গিয়েই থমকে দাঁড়াতে হল। এত সকালে পুকুরে কাউকে চান করতে দেখবে ভাবে নি। দাঁড়িয়ে চান নয়, মনের আনন্দে সাঁতার কাটছে আর জলে ভাসছে শঙ্কর সারাভাই। ঋজু, পরিপুষ্ট দেহ জলের ওপর যেন কখনো চঞ্চল কখনো বা শিথিল অবকাশ-বিনোদনে রত। যশোমতী যে ভব্যতার আবহাওয়ায় মানুষ, তার চলে আসা উচিত, ফিরে আসা উচিত। তাদের ঘরের পুরুষেরাও স্নানের পর গায়ে জামা না চড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরোয় না। কিন্তু স্থান-কাল ভুলে সে দাঁড়িয়েই রইল, আর চেয়েই রইল।
সাতারের পর ঘাটের কাছে এসে নিটোল পুষ্ট দুই হাতে গাত্র মার্জনা শুরু হল। শক্ত হাতের তাড়নায় পেশীগুলো ফুলে ফুলে উঠছে। প্রথম সূর্যের আলো পড়েছে লোকটার মুখে। যশোমতী আরো অবাক, গালে মুখে কালকের সেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর নেই, চানের আগে এরই মধ্যে কখন দাড়ি কামানোও হয়ে গেছে। রীতিমত সুশ্রী দেখাচ্ছে ঝাকড়া চুলে ঢাকা মুখখানা।
পুরুষের মূর্তি…
পুরুষের এই মূর্তি কি যশোমতী আর দেখেছে?
রীতিমত সাড়া জাগিয়ে ক্ষুদ্রকায় রাজুর আবির্ভাব। হারানো প্রিয়জনের সন্ধান মিলেছে যেন।–মাসি, তুমি এখানে! আমি আর মা সেই থেকে তোমাকে খুঁজছি।
যশোমতীর সমস্ত মুখ পলকে রাঙা। আরো নাজেহাল অবস্থা ভাগ্নের কলকণ্ঠ শুনে অদূরে স্নান যে করছে সে ফিরে তাকাতে। যশোমতী পালাতে পারলে বাঁচে। কিন্তু বিপদের ওপরে বিপদ, লোকটা হাতের ইশারায় কাছে ডাকছে। পালাবার মুখেও বিমূঢ় মুখে দাঁড়িয়ে গেল। দু’জনের কাকে যে ডাকছে ভাগ্নেকে নাতাকেই– হঠাৎ ঠাওর করতে পারল না যশোমতী।
যে ডাকছে তার মুখে কোনরকম সঙ্কোচের চিহ্নমাত্র দেখতে পেল না। এদিকে খুশির দূত ক্ষুদ্র সঙ্গীটি ততক্ষণে তার হাত ধরে ঘাটের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে–রাজুর যেন এই মুহূর্তে ওখানে না গেলেই নয়। বলছে, মামা এক ডুবে পুকুরটা এপার-ওপার করতে পারে, বুঝলে? দেখবে এসো–
না, ডাকছে ভাগ্নেকেই। যশোমতী সামনে এসে দাঁড়ানো সত্ত্বেও কোনরকম সঙ্কোচের লক্ষণ দেখল না, প্রশস্ত বুকের ওপর ভিজে গামছাটা পর্যন্ত ফেলল না। তার দিকে একবার তাকিয়ে ভাগ্নেকে বলল, চান করবি তো নাম–
মামাকে হঠাৎ এ-রকম উদার হতে দেখে ভাগ্নে অবাক একটু। পরক্ষণে আত্মহারা আনন্দে টেনে-হিঁচড়ে গায়ের জামাটা খুলে যশোমতীর হাতে দিয়ে তরতর করে জলে নেমে গেল। না মাথায় তেল, না গায়ে। জামা হাতে যশোমতী দাঁড়িয়ে রইল, ওদিকে ভাগ্নেকে উল্টে-পাল্টে চান করাতে লাগল শঙ্কর সারাভাই। তাদের দুজনেরই মুখে হাসি ধরে না।
একটু বাদে দিদিও হাজির।–দেখেছ কাণ্ড! এই সাত সকালে ছেলেটাকে ধরে চান করাতে লেগেছে।
তার মুখে কিন্তু অখুশির ছায়া দেখল না যশোমতী। রাতের বিরূপতা সকালে মুছে গেছে।
রাজুর ডাকে যশোমতী সচকিত।…মাসি তুমিও নেমে পড়ো না! সাঁতার জান না বুঝি? কিছু ভয় নেই, মামা জানে, ধরবে-খন।
মামার ধমক শোনা গেল, ধ্যেৎ।
মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দিদির প্রস্থান। যশোমতীও দ্রুত অনুসরণ করে বাঁচল।
চানের পর অবশ্য সেই দুপুরের আগে আর শঙ্কর সারাভাইয়ের দেখা পেল না যশোমতী। স্কুলে দেখা করার ব্যাপারটা আজ যদি কোনরকমে কাটিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে কি একটা উপলক্ষে পর পর তিন দিন ছুটি। আজও দেখা করতে যেতে আপত্তি ছিল, কিন্তু জুতোর সমস্যা। গয়না না বেচা পর্যন্ত এক জোড়া স্যান্ডাল কেনারও উপায় নেই। তাছাড়া, বলা নেই কওয়া নেই, মুখ ফুটে এই একটা নগণ্য চাকরি চাইতে যাওয়ার যে মানসিক প্রস্তুতির। দরকার, তাও নেই। মোট কথা, লোকটার ও-রকম জেরায় পড়ার আগে প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করার কথা সে কখনো ভাবেও নি। স্কুলের চাকরি যদি কোথাও করতেই হয় তাহলে এখান থেকে চলে গিয়ে কোনো হাইস্কুলে চেষ্টা করাই সঙ্গত।
কিন্তু এখানে থাকার ব্যাপারেও তো চক্ষুলজ্জা কম নয়।
সেই লজ্জার অবসান দিদিটিই করে দিল। সকালে মুড়ি দিয়ে জলযোগ সারার পর সঙ্কোচ-বিনম্র মুখে সমস্যাটা দিদির কাছে যশোমতীই ব্যক্ত করল। বলল, এ-রকম শূন্য হাতে স্কুলে এখন সে দেখা করবে না, তার থেকে আপাতত বরং তার ফিরে যাওয়াই ভালো। কারণ, কাজের সুবিধে হলে তখন স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে সময় চাওয়াটা ঠিক হবে না। কিন্তু নানা কারণে ফেরার ইচ্ছে তার একটুও নেই, অনেক রকম ঝামেলায় পড়ার সম্ভাবনা। এখন দিদি যদি তার এক আধখানা গয়না বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়–তারপর সে ভেবে-চিন্তে যাহোক ঠিক করতে পারে। এসব গয়না তার দাদার দেওয়া নয়, বাবার দেওয়া আর হাতের টাকা চুরি গেছে যখন দুই-একখানা গয়না বিক্রি তো করতেই হবে, ইত্যাদি।