কাপড়-কলের দেশে সাহিত্য-সম্মেলনের আড়ম্বর হবে শুনে মনে মনে যারা মুচকি হেসেছিল তারাও ভিতরে ভিতরে আমার মতই অপ্রস্তুত হয়েছে হয়তো। টাকা আছে অথচ সাহিত্য-প্রীতি নেই, এই দিনে সেটা মানহানিকর ব্যাপার প্রায়। সাহিত্য-সম্মেলনও সেই গোছছরই হবে ধরে নিয়েছিল সকলে। কিন্তু ঐশ্বর্যের সঙ্গে মার্জিত রুচি তার সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগের দিকটা যে কত সহজভাবে মিশে আছে, এখানে এসে গোড়াতেই সেটা উপলব্ধি করতে হবে। লক্ষ্মী সরস্বতীর চিরন্তন বিবাদের কথা মনে হবে না।
বিশেষ বিত্তবানদের প্রতি বিপরীত অবস্থার মানুষের এক ধরনের মানসিক বিরাগ আছেই। এই বিরাগের প্রধান হেতু বোধ করি বিত্তবানের হৃদয়শূন্যতা, পারিপার্শ্বিক মানুষের প্রতি তাদের নির্লিপ্ত উদাসীনতা। বিত্ত তার চারদিকে একটা বৃত্ত টেনে দেবেই। কিন্তু সেই বৃত্তটা ছোট বা সংকীর্ণ হলে যতটা চোখে লাগে, বড় হলে ততটা লাগে না বোধহয়। আমাদের চোখ ছোট বৃত্ত দেখে অভ্যস্ত। সেখানে স্বার্থ আর আত্মচেতনা আর মর্যাদাবোধ যেন সর্বদাই একটা ধারালো ছুরি হাতে পাহারায় বসে আছে। সেখানে হৃদয়ের কারবার নেই।
হৃদয়ের কারবারের খবর এখানেও খুব রাখিনে। কিন্তু এখনকার বৃত্তটা যে বড় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই বড় বৃত্তের সঙ্গে পুরুষকার মিশলে তার চেহারা অন্যরকম। আর তার মধ্যে মানসিক সলতা প্রতিফলিত হলে তা চেহারা আরো অন্য রকম। এই সামগ্রিক বিত্তের দেশে পথে-ঘাটে যে একটিও ভিখিরি চোখে পড়ল না সেটা নিশ্চয় চোখ বা মনের দিক থেকে অবাঞ্ছিত নয়। এ-হেন জায়গায় হঠাৎ বড়লোক হবার নেশায় পাগল হয়ে ছুটবে এমন একটিও রেসকোর্স যে নেই, এও নিশ্চয় এক সামগ্রিক মানসিক পুষ্টির লক্ষণ। এই পুষ্টির চেহারাটা সর্বত্র চোখে পড়ে না। না পড়লে আমাদের অভ্যস্ত চোখে তেমন ধাক্কা বা খোঁচাও লাগে না। কিন্তু পড়লে ব্যতিক্রম মনে হয়। এখানকার শিক্ষার ব্যবস্থাও সাবরমতীর মতো বহু ধারায় একে-বেঁকে গেছে। প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এখানেই। এর অধীনে শুনলাম বাহাত্তরটি কলেজ, আর তার মধ্যে একুশটি নাকি আছে এই শহরেই। কত রকমের কলেজ তার ফিরিস্তি দেওয়া নিয়োজন। শুধু অর্থ আর কচি এখানে বিপরীত বাস্তায় চলছে না কেন, সেই প্রসঙ্গে এই উক্তি।
বিদেশে এসে সেখানকার একজন লোককেও দেশের ভাষায় কথা বলতে শুনলে আপনার ভালো লাগবে। কিন্তু এসে যদি শোনেন এবং দেখেন আপনার দেশের ব্যাপক সাহিত্যচিন্তার এক বৃহৎ সমজদারগোষ্ঠ আছে সেখানে–তাহলে সেই ভালো লাগাটা বুকের একেবারে কাছাকাছি কোথাও পৌঁছতে বাধ্য। শরৎবাবু যে এখানে সমষ্টিগতভাবে এমন এক হৃদয়ের আসনে প্রতিষ্ঠিত কখনো কল্পনাও করিনি। ঘরে ঘরে তাঁর ছবি, ঘরে ঘরে তার অনুবাদ-সাহিত্য। ভাষা-শিক্ষার ব্যাপারে এখানকার ছাত্রছাত্রীদের সব থেকে বেশি ভিড় বাংলা ক্লাসে। এর পিছনে একটাই কারণ। আমাদের কবি আর আমাদের লেখককে তাদের জানার আগ্রহ। এই আগ্রহ কল্পনার বস্তু নয়, বাস্তব সত্য। এতে তাদের জাতীয় বৈভবের কোনো খাদ মেশেনি। অল্পবয়সী এত ছেলেমেয়ে ছোটাছুটি করে এসে বাংলায় কথা বলবে, বাংলায় অভ্যর্থনা জানাবে-বাংলা সাহিত্য-সম্মেলনে এসেও এ আর কে আশা করেছিল?
বিলাস-ব্যসনের অনুষ্ঠান বলতে নাটক নাচ আর গান। এখানকার আবালবৃদ্ধ-বনিতা এই তিন কলার ভক্ত। প্রচুর খরচও হয় এতে। সম্মেলনে তিনের ব্যবস্থাই ছিল। নাটক একদিন, নাচ আর গান প্রতিদিন।
কমলা-তনয়া যশোমতী পাঠকের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ এক সন্ধ্যার গানের আসরে। কিন্তু এ কাহিনী বিস্তারের মত অনুকূল নয় সেটা আদৌ।
সাহিত্যের আসরে আগেও ক’দিন দেখেছি মহিলাকে। শুনেছি, আমাদের আপ্যায়ন এবং অভ্যর্থনার ব্যাপারে তারই উদার হাত সব থেকে বেশি প্রসারিত। অবশ্য সেটা প্রকাশ্যে নয়। সে-ও খুব অভাবনীয় মনে হয়নি, কারণ অপ্রকাশ্য উদারতা শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হয়েই পড়ে আর তাতে ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনের চটক বাড়ে। মহিলা অধিবেশনে আসা মাত্র স্থানীয় ব্যবস্থাপকদের একটু বেশি মাত্রায় সচেতন হতে দেখেছি। এক পাশের একটা নির্দিষ্ট আসনে বসে ঈষৎ কৌতুকমেশা গাম্ভীর্যে তাকে অধিবেশনের আলোচনায় মনোনিবেশ করতেও দেখেছি।
দেখেছি, তার কারণ মহিলার সম্বন্ধে এখানকার বাঙালী বাসিন্দাদের মুখে নিজের পেশাগত কিছু রসদের সন্ধান পেয়েছি। অবশ্য তখনো সম্পূর্ণই আগোচরের রসদ সেসব। অর্থাৎ মহিলাকে দেখার আগের রসদ। সেটা সব থেকে বেশি যুগিয়েছে ত্রিপুরারি ঘোষ। বস্তুত, আমার এখানে আসাটা সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের আগ্রহের দরুন যতটা না, তার থেকে অনেক বেশি ত্রিপুরারিয় তাগিদে। না এলে জীবনে আর মুখ দেখবে না, চিঠিতে এমন হুমকিও দিয়েছিল সে। লিখেছিল, তার প্রাণের দায় না এলেই নয়।
যশোমতী প্রসঙ্গে এই ত্রিপুরারির মুখখানা উদ্ভাসিত হতে দেখেছি কতবার ঠিক নেই। অথচ স্বভাবের দিক থেকে বরাবর ওকে নীরস গদ্যকারের মানুষ বলে জানি। ছোট একটা কবিতা মুখস্থ করতে গলদঘর্ম হয়ে উঠত, কিন্তু লাভ-লোকসানের দুরূহ অঙ্কের ফল মেলাতে ওর জুড়ি ছিল না। ছেলেবেলা থেকে হিসেব করে চলত, উচ্ছ্বাসের মুখেও হিসেবের রাশ টেনে ধরত, পাছে কাউকে পাওনার অধিক দিয়ে বসে। সে টাকা-পয়সাই হোক বা নিন্দা-প্রশংসাই হোক। হস্টেলের ও ছিল ম্যানেজার। বাজার সরকারের মোটা চুরি ধরা পড়েছিল একবার। কিন্তু সরকার এমন নিখুঁত হিসেব দিয়েছিল যে তাকে বরখাস্ত করার বদলে দু’টাকা মাইনে বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল ত্রিপুরারি।