শীতারম্ভের এই সময়টায় সাহিত্য-সম্মেলন ব্যবস্থার দরুন উদ্যোক্তাদের মনে মনে ধন্যবাদ জানিয়েছি। নইলে দেখা হত না এই দেব-উঠি-আগিয়ারস্। আমি একালের মানুষ। স্বভাবতই একালের মন, একালের দৃষ্টি, একালের হৃদয় নিয়ে বসে আছি। শুধু আমি কেন, সকলেই। তবু এমনি সমাবেশে এলে মনে হয়, আমাদের এই দৃষ্টি মন হৃদয়ের একটা দিক বুঝি কবেকার কোন সাধক ভারতের চতুষ্পথে বসে আছে। সেই ভারত বা সেই অতীতের সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। তবু সুদূর অতীতের কোনো অনাবিল পুষ্টির সঙ্গে সত্তার একটা অবিচ্ছেদ্য যোগ থেকেই গেছে। নইলে দেবতা উঠবেন শোনামাত্র একালের এই অশান্ত মন-সমুদ্রের তলায় তলায় নিঃশব্দ একটা ঢেউ ওঠে কেন? বহুকালের হারানো অথচ প্রায়-চেনা পথের স্মৃতি বার বার পিছনপানে টানে কেন?
আর ক’টা দিন থেকে যান। শুক্লা-একাদশীর উৎসব দেখে যান। রমণীর সদয় মিষ্টি আতিথ্য বড় লোভনীয়ভাবে প্রসারিত হয়েছিল। এখানকার যে রমণীটি সকলের মধ্যমণি, তার প্রস্তাব।
–সেটা কি ব্যাপার? আমি উৎসুক হয়েছিলাম।
–দেব-উঠি-আগিয়ারস–দেবোত্থান একাদশী।
—কি হয়?
মহিলা হেসে বলেছিল, হয় না কিছু। নদীর ধারে সকাল থেকে মেলা বসে।
বাংলাদেশের ছেলে, মেলা শুনে অভিভূত হবার কারণ নেই। তবু নতুন জায়গায় সব আকর্ষণ ছেড়ে মেলা দেখে যাবার প্রস্তাব শুনে বলেছি, দেশে মেলা দেখে দেখে এখন মেলার কথা শুনলে ভয় করে। এটা কি-রকম মেলা?
মেলার আলোচনা উপলক্ষ। লক্ষ্য, অবকাশ যাপন। সেটা মনের মতো হলে সবই ভালো লাগে। সামান্য আলোচনাও বৈচিত্র্য মনে হয় না। মহিলা তেমনি হেসেই বলেছিল, কি-রকম আর, সব মেলা একই রকম। সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষ মেলে, আবার মন চাইলে দু’একজন মানুষেরও সন্ধান মেলে।
মহিলার হাসিমাখা মিষ্টি মুখে বাড়তি একটু লালিমা চোখে পড়েছিল কিনা ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু কথা ক’টা আমার কানে লেগেছিল। আজও লেগে আছে।
আজ যদি শুনি, কোনো কুবেরাধিপ সার অমুকের মেয়ে অথবা সার তমুকের বউ স্বল্প-পরিচয়ের অতিথিকে দেশের কোনো মেলা দেখে যাবার জন্য আপ্যায়ন জানাচ্ছে, কানের পর্দায় একটা নাড়াচাড়া পড়ে যাবে বোধ করি। যে মহিলার কথা বলছি এখানে তার মর্যাদা আরো বেশি ছাড়া কম নয়। কোনো পুরুষের গৌরবে গরবিনী নয়, নিজেই সে ভাগ্যের তুঙ্গশিখরাসীনা। তার লক্ষ্মীর প্রসাদ-ভাণ্ডারের দিকে তাকালে অনেক ভাগ্যবানের দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়বে। শুনেছি এই লক্ষ্মীর প্রসাদ-ভাণ্ডারের দিকে তাকালে তা তো বটেই। ঐশ্বর্য-ভাণ্ডারের সঠিক হিসেব সে নিজেও রাখে না। বড় বড় কাপড়ের কলের সংখ্যা এখানে পঁচাত্তরের উপরে। তার দু’একটার মালিক হওয়া খুব বড় কথা নয় এখানে। এই দেশে লক্ষ্মীর সমুচ্ছল পদক্ষেপ বস্ত্রশিল্পের পথ ধরেই। কিন্তু বড় মিলগুলোর মধ্যেও যদি শুধুমাত্র একটিকে সবগুলোর চুড়ো হিসেবে বেছে নেওয়া যায়, দেখা যাবে সেই মিলের অধিশ্বরী এক মহিলা। যে রমণী এখানকার কটন চেম্বারের অধিনায়িকা–এ বছরের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট।
সেই রমণী। সেই মহিলা। আমাকে সাবরমতীর দেবোত্থান একাদশীর মেলা দেখে যাবার জন্য সাদর আমন্তণ জানিয়েছে।
…. যশোমতী পাঠক।
এই নাম এখানকার সর্বস্তরের মেয়ে-পুরুষের সুপরিচিত।
হ্যাঁ, এখানকার সব থেকে বড় কটন মিলের মালিক, কটন্ চেম্বারের প্রেসিডেন্ট যশোমতী পাঠক সেই এক সন্ধ্যায় বলেছিল এই কথা। বলেছিল, কি-রকম আর, সব মেলা একই। সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষ মেলে, আবার মন চাইলে দুই-একজন মানুষেরও সন্ধান মেলে।
আমি হাঁ করে তার মুখের দিকে চেয়ে ছিলাম। তাতে অভব্যতা ছিল না, বিস্ময় ছিল। কারণ, মনে মনে আমি তার দিন কতক আগে থেকেই দুটি নারী-পুরুষের জীবন-চিত্রের একেবারে অন্তঃপুরে বিচরণের চেষ্টায় ছিলাম। সেটা এই মহিলা জানে। শুধু জানে না, এই একটি কারণে আমার কিছু লাভ হয়েছিল। সে রকমটা আর কোনো অভ্যাগতর কপালে অন্তত জোটেনি। মহিলার পরোক্ষ প্রশ্রয়ের ফলে এই সাবরমতীর দেশে আসাটা আমার সার্থক মনে হয়েছিল।
শোনামাত্র সেই মুখের দিকে চেয়ে আমি কিছু দেখতে চেষ্টা করেছিলাম। মনে হয়েছিল, সাবরমতীর ওই মেলার সঙ্গে তার কোনো একটা নিরবচ্ছিন্ন মেলার ধারা মিশে আছে। যশোমতীর মন কাউকে চেয়েছিল, খুঁজেছিল। কারো সন্ধান মিলেছিল।
হতে পারে, দেবতা উঠেছিলেন।
.
কিন্তু এ-প্রসঙ্গ পরের বিস্তার সাপেক্ষ। সাহিত্য-অধিবেশন উপলক্ষে সদ্য-আসা এই দুই চোখ তখন শুধু এই জায়গাটা আর তার মানুষগুলোকে দেখে বেড়াচ্ছিল। যশোমতী সম্পূর্ণ অপরিচিত তখনো। নামটাই শুধু শোনা ছিল। সম্ভাব্য কোনো কাহিনীর গতি যে এই পথে গড়াবে, সেটা কল্পনার বাইরে। আমি তখন শুধু সাবরমতী চিনতে চেষ্টা করছিলাম।
নদীর কথায় যশোমতীর কথা এসে গেছে।
নদীর জল নীলাভ। নীল আভার সঙ্গে মানুষের ধমনীর রক্তের অদৃশ্য কি যোগ কে জানে। চারদিনের সাহিত্য-সম্মেলন উপলক্ষে এই প্রায়-অপরিচিত মানুষদের উদ্যম দেখেছি, উৎসাহ দেখেছি, উদ্দীপনা লক্ষ্য করেছি। আমরা, বিশেষ করে খাস বাংলার সাহিত্যিকরা যেন ভারি প্রিয়জন তাদের। প্রিয়জনের প্রতি অন্তরঙ্গতার আতিশয্য যেটুকু, সেটুকুও অন্তরের। তাদের ঐশ্বর্যের ছটা থেকেও ছোট বড় নির্বিশেষে অন্তরের এই সামগ্রিক খুশির ছটাটুকুই বেশি টেনেছিল আমাকে।