–আমার। যা ছিল কুড়িয়ে-বাড়িয়ে নিয়ে এসেছি।
–তুই নিজে ফাটকায় খাটাবি?
মুখ তুলে তাকানো বা ভালো করে বুঝিয়ে জবাব দেবারও ফুরসত নেই যেন।-হ্যাঁ, কপাল ভালো থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে ওর ডবল ঘরে ফিরবে। তা না হলে পনেরো দিনের মধ্যে।
নিজের টাকা খাটাতে যাচ্ছে শুনে ভদ্রলোকের লোভ যত অস্বস্তিও ততে। জিজ্ঞাসা করল, ডবল না ফিরে উন্টে তোর এই সামান্য টাকা যদি সব যায়?
–যাবে না। গম্ভীর মুখে নিতান্ত আত্মীয় বলেই যেন আর এক বার প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখার কথা বলাটা কর্তব্য বোধ করল। –যদি পারো হাজার দুই বার কর! যাবে মনে হলে নিজের যথাসর্বস্ব নিয়ে আমি মৌলা থেকে ছুটে আসি?
অকাট্য যুক্তি। ফলে দুর্বার প্রলোভন। কিন্তু দু’হাজার শুনে। মেসোর চোখ কপালে। আবার দু’হাজার শুনেছে বলেই লোভটাও প্রবল। ‘সে-রকম খবর কিছু না থাকলে দু’পাঁচ শো চাইত। বলল, দু’হাজার টাকা কোথায় পাব আমি। ব্যাঙ্কের পাস-বই তো তোর মাসির হাতে।
শঙ্কর নির্লিপ্ত।–থাক তাহলে।
কিন্তু থাক বললেই ছেড়ে দেওয়া যায় না। নিশ্চিত লাভের উৎসটা কোথায় সে সম্বন্ধে মেসো খোঁজ-খবর করতে লাগল। ফলে মেসোর প্যাড টেনে নিয়ে শঙ্কর হাতে-কলমে তাকে বোঝাতে বসল। গাছের ফলের মতো কোথায় কোন রহস্যের ডালে টাকা ঝুলছে, কাগজ-কলম হাতে পেলে শঙ্কর সেটা যত পরিষ্কার করে বোঝাতে পারে মুখে ততো না। মেসোর তখন মনে হয় ওই কাগজ কলম যেন ছেলেটার হাতে টাকার ফল পাবার একখানা আঁকশি।
কিন্তু বাধা পড়ল। এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে প্রায় চোখ রাঙিয়েই গেল মেসোকে। তার বক্তব্য দু’দিন ধরে ওমুক দরকারী ফাইল আটকে বসে থাকলে কাজ চলে? তিন দিন ধরে ফাইল খুঁজে খুঁজে হয়রান সকলে, শেষে জানা গেল ফাইল এখানে ঘুমুচ্ছে।
অনুযোগ শুনে মেসোর বিড়ম্বিত মুখ। আমতা-আমতা করে আগন্তুককে নিশ্চিন্ত করতে চেষ্টা করল–পরদিনের মধ্যেই ফাইল পাঠাচ্ছে সে। একসঙ্গে অনেক ফাইল জমে গেছল বলে পেরে ওঠেনি।
লোকটি চলে যেতে শঙ্কর জিজ্ঞাসা করল, তোমার অফিসার নাকি?
মেসো তেমন খেয়াল না করে জবাব দিল না, আমার আণ্ডারে কাজ করে। তারপর বলো–
আণ্ডারের লোকের দাপট দেখে মুচকি হেসে শঙ্কর আবার প্যাডের হিসেব বিশ্লেষণে মন দিল। লাভের রহস্যটা যখন প্রায় বেরিয়ে আসার মুখে ঠিক তক্ষুনি আবার ব্যাঘাত। ঘরের হাফ দরজা ঠেলে আর একটি সুদর্শন মাঝবয়সী লোকের আবির্ভাব।
এসেই ভারিক্কি চালে বলল, আপনি কি অফিস লাটে তুলে দেবেন নাকি? একসঙ্গে চারজন ক্লার্ককে হুট করে ছুটি দিয়ে বসলেন, ডিপার্টমেন্ট চালাবে কে?
বিব্রত মুখে মেসো কৈফিয়ত দিল, কেন, ওরা তো কাজ মোটামুটি করে রেখে গেছে শুনলাম, তা ছাড়া খুব দরকার বলল যে–
ভদ্রলোকের মুখে এবং গলার স্বরেও রাজ্যের বিরক্তি।দরকার তবে আর কি, গোটা অফিসটাই ক্লোজ করে দিন তাহলে। এক্ষুনি রিজার্ভের লোক পাঠিয়ে দিন, ছুটি যারা নেয় তারা কাজ সেরে রেখে ছুটি নেয় না।
লোকটি দরজা ঠেলে বেরিয়ে যেতে শঙ্কর আবার জিজ্ঞাসা করল, ইনি বুঝি তোমার অফিসার?
মেসো বিরক্ত।–অফিসার হতে যাবে কেন, আমার আণ্ডারে ক্লিয়ারেন্স ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ
শঙ্কর হেসে উঠল, বলল, সব থেকে নিচের কেরানী হওয়া উচিত ছিল তোমার। নিচের লোককে এই রকম আশকারা দাও তুমি! তোমার অধীনের লোকেরা ওপরওলার মতো এসে মেজাজ দেখিয়ে যায়, লজ্জাও করে না তোমার?
ক্ষুব্ধ মুখে মেসো বলল, এই রকমই পার্টিনেন্ট হয়েছে সব আজকাল। সেদিনের ছেলে সব, রাগ করলেও পরোয়া করতে চায় না, উল্টে তর্ক করতে আসে।
শঙ্কর অভিজ্ঞ ওপরওলার মতোই পরামর্শ দিল, দরজা ঠেলে হুট হুট করে এভাবে ঢুকতেই দাও কেন সকলকে, এই জন্যই তো এত প্রশ্রয় পায়! বেয়ারাকে দিয়ে খবর পাঠালে তবে ঢুকতে দবে। তা না, যে খুশি এসে চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে।
মর্যাদা বজায় রাখার জন্য মেসো তক্ষুনি তার কথায় সায় দিয়ে বলল, সব ঢিট করে দেব একদিন–আমি রাগলে সাঘাতিক অবস্থা। তারপর এদিকের কি ব্যাপার তুই বল ভালো করে।
ব্যাপার প্রায় শেষ করেই এনেছিল শঙ্কর সারাভাই। শেষ লাভের অঙ্কটা যা ছক কেটে দেখাতে বাকি। চৌকোস মাস্টারের সহজ করে দুরুহ আঁকের ফল দেখানোর মতো শঙ্কর তাও দেখিয়ে দিল। এটুকু শেষ হতে মহাদেব সারাভাই এক ধরনের যাতনা বোধ করতে লাগল যেন। লাভের যাতনা। বলল, কিন্তু টাকা পাই কোথায়? ।
শঙ্কর চুপ। এ সমস্যার সমাধান তার হাতে নেই। মেলো আর কোন পথ না পেয়ে শেষে তারই শরণাপন্ন যেন।–তুই-ই না হয় তোর মাসিকে যা-হোক কিছু বলে দেখ না চেকবইটা বার করতে পারিস কি মা। তোকে তো ছেলের মতোই দেখে, মাথা থেকে একটা কারণ-টারণ যদি বার করতে পারিস, দিলে দিতেও পারে। আমি বললে কানেও তুলবে না।
চেক-বই কি করে বার করা যায় সেই চিন্তা শঙ্কর সারাভাই করেই এসেছে। তবু ধীরে-সুস্থেই উপায় বাতলালো সে। বলল, এমনিতে চেকবই চাইতে গেলে মাসি আমাকেও ছেড়ে কথা কইবে নাকি–সতের রকমের জেরা করে শেষে ডাণ্ডা নিয়ে তাড়া করবে। ….এক কাজ করা যায়, আমার ফ্যাক্টরির খুব একটা বড় অর্ডার। পেয়েছি বলা যেতে পারে। মোটা টাকা লাভের আশা আছে জানিয়ে যদি তাকে বুঝিয়ে বলি দিন সাতেকের জন্য হাজার খানেক টাকা দরকার–পার্টির পেমেন্ট পেলেই টাকাটা দিয়ে দেব, আর লাভের অংশও দেব-তাহলে?