কোথায় যাবে বা কি করবে এখনো ভাবা হয় নি। ভাবতে হবে। কিন্তু এখানে বসে নয়, বেশ দুরে কোথাও গিয়ে ভাবতে হবে। যেখানে গেলে কেউ তার হদিস পাবে না। তারপর ভেবেচিন্তে আরো অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে হবে। এই আভিজাত্যের শো-কেস থেকে অনেক দূরে।
০৫. মাথা আর চিন্তা আর দূরদৃষ্টি
শঙ্কর সারাভাইয়ের মাথা আর চিন্তা আর দূরদৃষ্টির ওপর কারো যদি বিশেষ আস্থা থেকে থাকে–সেটা ছিল তার মেসো মহাদেব সারাভাইয়ের।
কিন্তু মগজের ওপর আস্থা যত ছিল, তার চাল-চালন কাজকর্মের প্রতি বিশ্বাস ততো ছিল না। নইলে এতবড় কষ্ট চেম্বারের সে সুপারিনটেনডেন্ট, কত লোককে এখানে কোল, কতজনের সংস্থান করে দিল, কতজনকে ওপরে তুলল, ঠিক নেই। মানুষ করতে পারল না শুধু স্ত্রীর আদরের বোনপোটিকে। তার মতো বি. এসসি. পাস করে সাত বছর ধরে ছোকরা ভ্যারেণ্ডা ভাজছে। তার অফিসে চাকরি করার জন্য কতদিন সাধাসাধি করেছে, কিন্তু এখনো হতভাগা আকাশ কুসুম কল্পনা নিয়ে আছে। চিন্তা করলে কাজের চিন্তা করতে পারে সেটা তার থেকে বেশি আর বোধহয় কেউ জানে না। কিন্তু সেদিকে মাথা না মন।
বাপের যা ছিল কুড়িয়ে কাঁচিয়ে ব্যবসায় ঢেলেছে। সেও শহরে নয়, এখান থেকে চল্লিশ মাইল দূরে মেলায় গিয়ে। ব্যবসা বলতে ভাঙাচোরা মেশিন একটা, নিত্য অচল হয়, আর গোটাকতক তাত। বিধবা বড়বোনকে নিয়ে সেখানেই থাকে–হাঁড়িতে জল ফোটে, দোকানে চাল। তবু ব্যবসা করার গো যায় না। ওদিকে মূলধনের অভাবে মাসের মধ্যে দশদিন ফ্যাক্টরি বন্ধ। চলুক না চলুক গাল-ভর। নাম না হলে মন ওঠে না–চাল নেই চুলো নেই, তবু ফ্যাক্টরি। আজ যন্ত্র বিগড়ল, কাল সুতোয় টান পড়ল–এমনি একটা না একটা লেগেই আছে।
মেসো নিঃসন্তান। অতএব বোনপোর প্রতি স্ত্রীর স্নেহ ঠেকাবে কি করে। টাকার দরকার হয়ে পড়লে মাসি-অন্ত প্রাণ ছেলের। মাসিও টাকা চেনে না এমন নয়। কিন্তু একবার যদি হুকুম হয়ে গেল, দাও, তো দাই। কম করে দু-তিন হাজার টাকা এ পর্যন্ত তাকেও শ্ৰীমানের ওই ব্যবসায় ঢালতে হয়েছে। সেই টাকা সব জলে গেছে। বার কয়েক ঘা খেয়ে তবে স্ত্রীর একটু টনক নড়েছে। ভদ্রলোকের রোজগার ভাল, খরচ কম। তাই হাতে আছেও কিছু। কিন্তু কৃপণতার ধাত। শঙ্করকে মনে মনে পছন্দ করে, কিন্তু তাকে দেখলে অস্বস্তি বোধ করে। ভয়, এই বুঝি খসাতে এলো কিছু।
কিন্তু তবু এই ছেলেটাকে পছন্দ করারও একটা কারণ আছে। ভদ্রলোকের টাকার ওপর লোভ খুব। আগে আগে এই লোভে শঙ্কর ভালই ইন্ধন যুগিয়ে এসেছে। যে বিশ্বাসের ফলে টাকার মুখ দেখা যায়, সেই বিশ্বাসটাকে সকলেই আঁকড়ে ধরতে চায়। ম্যাজিকের মতো হাতে-নাতে সেই ফল দেখিয়ে ভদ্রলোককে ঘায়েল করেছে সে। তাই তার ওপর ক্ষোভও যেমন তলায় তলায় আশাও তেমন।
ব্যবসায় দুর্বুদ্ধি মাথায় চাপার আগে কিছুকাল শেয়ারবাজারে ঘোরাঘুরি করেছিল আর সেখানে থাকতে ছোকরার মাথাও ভালো খুলেছিল। সেখানকার কিছু মাথাওয়ালা লোকের সঙ্গে খাতিরও হয়ে গিয়েছিল। তাদের পরামর্শের সঙ্গে নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে বেশ দু’পয়সা বাড়তি রোজগারের সহায়তা করেছিল মেসোর। দুশো টাকা হাতে নিয়ে পনেরো-বিশ দিনের মধ্যে চার পাঁচশো টাকা এনে দিয়েছে–এমন বার কতক হয়েছে। এ ব্যাপারে বিশ্বাস বাড়তে বাড়তে মেসো এক-একবার হাজার দু-হাজার টাকাও তুলে দিয়েছে শঙ্করের হাতে। দেবার সময় তার হাত অবশ্যই কেঁপেছে আর সে টাকা ফিরে না আসা পর্যন্ত রাতে ভালো ঘুম হয় নি। তারপর আবার যে পরিমাণ টাকা ফিরেছে, তাতেও ঘুম হয় নি। শঙ্করকে এই নিয়েই থাকতে বলেছে সে, দিন-কাল সম্পর্কে অনেক গুরুগম্ভীর উপদেশ দিয়েছে। এমন কি উদার চিত্তে তার আর তার দিদির ভারও নিতে চেয়েছে। কিন্তু সুবুদ্ধি থাকলে তার এই দশা হবে কেন, তাহলে তো তার অফিসে চাকরিই করত একটা। মাথা দিয়ে কাজ করলে উন্নতিও যে সহজেই করতে পারত কোন সন্দেহ নেই। তার ওপর আপনার জন যখন আগেই মাথার ওপর। চাকরিটা করলে মেসোর দুর্ভাবনা থাকত না, হাতের মুঠোতেই রাখা যেত ওকে। আর মন দিয়ে তখন বাড়তি রোজগারের চেষ্টায়ও লাগা যেত। লাভ তাতে দু’জনেরই হত। কিন্তু চাকরির নাম মেসো আর মুখেও আনবে না। কারণ খোদ মালিককে বলে সেবারে চাকরি একটা ঠিক করেই ফেলেছিল। যেদিন জয়েন করার কথা সেদিন থেকে দু’মাসের মধ্যে আর তার টিকির দেখা নেই। তারপর তার অনুপস্থিতিতে লুকিয়ে লুকিয়ে মাসির কাছে আসা হয়েছে।
তার আগে মাসির ছটফটানি, বাউণ্ডুলেটা কোথায় উবে গেল, মৌলায় চিঠি দিয়েও জবাব পায় না। শেষে একদিন চুপি চুপি এসে নালিশ, চাকরি নেয় নি বলে মেসো আর মুখ দেখবে না ধরে নিয়ে আসা বন্ধ করেছে।
আর যায় কোথায়, আপিস থেকে মেসো বাড়ি ফিরে দম ফেলতে না ফেলতে মাসি মারমূর্তি।–নিজে তো গোলম হয়েইছে এখন সক্কলকে ধরে ধরে গোলামি না করাতে পারলে আর মুখ দেখবেন না। ব্যবসা করে ছেলেটা যা-হোক নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে, কোথায় উৎসাহ দেবে তা না, ছেলেটার বাড়ি আসা বন্ধ করেছে। এরকম লোকের নিজেরই মুখ দেখাতে লজ্জা করা উচিত, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
অথচ, আপিসে বোনপোর একটা ভাল চাকরি হোক দু’দিন আগেও স্ত্রীটির সেই আগ্রহ তার থেকে একটুও কম ছিল না।