এই থেকেই বিবাদ চড়চড় করে অন্তরায় একেবারে। বাবা অজস্র কথা বলতে লাগল। মায়ের প্রিয়পাত্রের প্রতি অর্থাৎ রমেশ চতুর্বেদীর প্রতি যশোমতীর এতটুকু টান নেই, কিন্তু তবু গোটা মেয়েজাতটার প্রসঙ্গে বাবার অপমানকর উক্তিগুলি যেন তপ্ত গলানো সিসের মতো যশোমতীর কানে ঢুকতে লাগল। যা বলে গেল তার সারমর্ম, ভালো মন্দ বোঝা দূরের কথা, অন্যের ওপর নির্ভর না করে দুনিয়ায় এক পা চলার মুরোদ নেই মেয়েদের। কাড়ি কাড়ি টাকা হাতের ওপর এনে। ঢেলে দেওয়া হচ্ছে বলেই আজ মান-মর্যাদার কথা। টাকায় মুড়ে রাখা হয়েছে বলেই দুনিয়াটা কি তারা টের পায় না–শো-কেসের পুতুলের মত নিরাপদ আভিজাত্যের কাঁচ-ঘরে সাজিয়ে না রাখলে নিজেদের ক্ষমতায় দু’দিন যাদের বেঁচে থাকার সামর্থ্য নেই দুনিয়ায়, তাদের আবার মতামত, তাদের আবার বিবেচনা। আরো বলেছে বাবা। বলেছে পায়ে হেঁটে একদিন রাস্তায় নেমে দেখে এসো কেমন লাগে, কত ধানে কত চাল-তারপর মান-মর্যাদার কথা বোলো। আর বলেছে, এই বাড়ি-ঘর এই ঐশ্বর্যের বাইরে গিয়ে দশ পা মাটিতে ফেলে হেঁটে দেখে নাও মাটির দুনিয়াটা কেমন, তারপর ভালো-মন্দ বোঝার দম্ভ দেখিও। হুঁঃ, ভালো-মন্দ বোঝে, মান মর্যাদার লড়াই–কে ফিরে তাকায় তোমাদের দিকে আগে একবার বুঝে আসতে চেষ্টা করলে ওই লম্বা লম্বা বুলি আর মুখে আসত না।
মায়ের এক একটা ক্রুদ্ধ জবাবের ইন্ধন পেয়ে বাবা এ-রকম অজস্র কথা বলে গেল। কথা নয়, এক এক প্রস্থ গলানো আগুন ঝরলো যেন। প্রতিটি রোযোক্তিতে সমস্ত নারীজাতির মান-সম্ভম একেবারে যেন আঁস্তাকুড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল।
মা তখনকার মতো কান্না জুড়ে দিতে বাবা ক্ষান্ত হল। কিন্তু যশোমতী কাঁদবে কি, তার দু’চোখ ধকধক করে জ্বলছে। সে এম-এ পড়ে, সে গানের স্কুল করেছে, সে মেয়েদের ক্লাব করেছে, সে যেখান দিয়ে হেঁটে যায় পুরুষের সঙ্গোপন অভিলাষ তার সঙ্গে ছোটে–এই নিয়েই পরম আনন্দে ছিল সে। কিন্তু বাবা এ-সব কি বলছে? বাবাও পুরুষ, পুরুষের চোখে আসলে তাহলে কতটুকু মর্যাদা তাদের? বাবার এই উক্তি যেন সমস্ত পুরুষেরই উক্তি। আজ যারা আশায় আশায় যশোমতীর দিকে এগিয়ে আসতে চাইছে, তারাও একদিন ওই কথাই বলবে। না যদি বলে, টাকার লোভে টাকার খাতিরে বলবে না। কিন্তু মনে মনে বাবা যা বলল তাই বলবে। বাবা যা ভাবে তাই ভাববে। বাবার তাহলে এই ধারণা? এই বিশ্বাস? তার টাকা আছে বলেই এই অভিজাত সমাজে তাদের যেটুকু দাম যেটুকু খাতির, যেটুকু মর্যাদা! তার শো-কেসের পুতুল, আভিজাত্যের কাঁচ-ঘরে লালন করে কোনো রকমে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হয়, নিজের পায়ের নির্ভরে দুনিয়ায় দুটো দিন তাদের বেঁচে থাকারও ক্ষমতা পর্যন্ত নেই! এত তুচ্ছ এত অক্ষম এত কৃপার পাত্রী তারা? বাবার এমন কথা!
সমস্ত রাত ধরে আগুন জ্বলল যশোমতীর মাথায়। কিছু একটা করতে হবে তাকে, জবাব দিতে হবে। সমস্ত মেয়েজাতের ওপর পুরুষের এত অবজ্ঞা এত অপমান সে বরদাস্ত করবে না। যশোমতী জবাব দেবে। দেবেই। সমস্ত রাত ধরে সঙ্কল্প দানা বেঁধে উঠতে লাগল।
পরদিন মা গভীর, কিন্তু যশোমতীর মুখ পাথরের মতো কঠিন। জীবনে কিছু একটা আমুল পরিবর্তন ঘটে গেছে তার। রাতের সঙ্কল্প দিনের আলোয় আরো বেশি আঁট হয়ে বসেছে মুখে।
যশোমতী প্রতীক্ষা করছে।
সকালে খুব ভালো করে চান করে উঠেছে। তারপর আবার প্রতীক্ষা করছে। এই বাড়ির কোনোদিকে সে তাকাতে পারছে না, কোনোদিকে চোখ ফেরাতে পারছে না–সর্বত্র শো-কেস দেখছে। আভিজাত্যের নিরাপদ শো-কেস। এই শো-কেস যোগায় বলে পুরুষের এত গর্ব এত দর্প আর তাদের প্রতি এত অবজ্ঞা।
যশোমতীর দম বন্ধ হবার উপক্রম।
দশটা না বাজতে বড় গাড়ি নিয়ে বাবা অফিসে বেরিয়ে গেল। যশোমতী আগেই ঠাণ্ডা মাথায় খেয়ে নিয়েছিল কিছু। কোনো ব্যাপারে ছেলেমানুষি করবে না। শো-কেস ভাঙতে চলেছে, ছেলে মানুষী করলে দ্বিগুণ হাসির ব্যাপার হবে। সে বাস্তবে নামতে যাচ্ছে, বাস্তব দেখতে যাচ্ছে, বাস্তব বুঝে চলতে হবে।
বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়ে মাকে বলল, এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে, ফিরতে দেরি হবে।
এটুকু মিথ্যার আশ্রয় না নিলেই নয়। যাই হোক, এই মিথ্যার পরমায়ুও বেশি হবে না নিশ্চয়। সত্য যা, তার আলমারির দেরাজে লেখা আছে। মাকে লেখে নি, তার জ্বালা আর যাতনা মা বুঝবে না। কতখানি অপমান বাবা করেছে মা জানে না। তাই আলমারির দেরাজে খামের চিঠি বাবার উদ্দেশ্যে লেখা। লিখছে, শো-কেসের পুতুল হয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই, মাটির দুনিয়া দেখতে চললাম, এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার সামর্থ্য যদি না-ই থাকে, তখন নিজেই তোমার শো-কেসে ফিরে আসব আবার, আর তোমার সব অপমান মাথায় তুলে নেব। তার আগে দয়া করে খোঁজ করে না। যশোমতী।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ব্যাঙ্কে এলো প্রথম। বাস্তব বুঝে চলতে হবে, তাই টাকা কিছু লাগবেই। দ্বিতীয় একখানা শাড়ি শুধু শৌখীন বড় ব্যাগটার মধ্যে পুরে নিয়েছে। ওই ব্যাগ ছাড়া সঙ্গে আর কিছু নেই।
প্রথমেই টাকা তুলতে হবে ব্যাঙ্ক থেকে। বলতে গেলে শূন্য হাতে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। ব্যাঙ্কে এলো। চেকে টাকার অঙ্ক বসানোর আগে ভাবল কত টাকা তুলবে। পঞ্চাশ হাজার, ষাট হাজার, সত্তর হাজার–যা খুশি তুলতে পারে। কত যে আছে সঠিক হিসেব রাখে না, আছে যে অনেক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার নামে থাকলেও কার টাকা তুলবে? বাবারই টাকা। যে-বাবার মতে তারা শো-কেসের পুতুল, নিজের পায়ের ওপর ভর করে যারা দাঁড়াতে শেখে নি। অতএব যত কম তোল যায়, কারণ যা তুলবে তা ধার হিসেবেই তুলবে। সেই ধারও একদিন শোধ করবে। করবেই। ভেবেচিন্তে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা তুলল। এতকালের প্রকৃতি ডিঙিয়ে পাঁচ হাজার টাকার থেকে নগণ্য অঙ্কের টাকা আর ভাবা গেল না। টাকা চেক-বই কলম ব্যাগে পুরে আবার বেরিয়ে পড়ল।