দাদা বলে, যোশীর শিকারে বেরুবার ইচ্ছে, আমরাও যাব ভাবছি, তুই যাবি?
অবধারিত ভাবেই যশোমতীর দু’ চোখ কপালে উঠবে। কারণ, দাদা এক-এক সময় যোশীর এক-একটা গুণ আবিষ্কার করে থাকে। তারপর চোখের নীরব বিস্ময় চৌচির হয়ে গলায় এসে ভাঙে।–….কি আশ্চর্য, তার আবার শিকারের শখও আছে নাকি!
-শখ মানে? নেশা! ক’টা বছর ব্যবসা নিয়ে মেতেছিল বলে, নইলে কোন্ গুণ না আছে তার? এ-রকম একটা ছেলেও তত আজকাল আর দেখা যায় না। দেখা যায় না সেই খেদে দাদার দীর্ঘনিঃশ্বাই পড়ে।
চমৎকৃত না হয়ে উপায় নেই যশোমতীর, মাথা নেড়ে সায় দেয়, সত্যি….ভদ্রলোক গান-বাজনায় ভালো, খেলাধুলোয় তো কথাই নেই, হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় ছেড়ে না দিলে লেখাপড়াতেও তার জুড়ি ছিল না শুনেছি, ব্যবসায়ও এত মাথা, এখন আবার শুনছি শিকারেও ওস্তাদ। আর আজকালকার ছেলেগুলো যা হয়েছে, কিছুতে পাকা হতেই মেরুদণ্ড বেঁকে যায়।
দাদার উদ্দীপনা চতুর্থন। গলা খাটো করে বলে, সেই জন্যেই তো বলছি, ওই রকম একটা ছেলেকে আত্মীয় করে নিতে পারা ভাগ্যের কথা।
যশোমতীর বোক বোক। বিস্ময়, তোমার নিজের শালা…. আত্মীয়ই তো!
ফলে বোনকে বোকাই ভাবে দাদা, এই এক ইঙ্গিত যে কতবার কত ভাবে করেছে, ঠিক নেই। কিন্তু ওর মাথায় কিছু ঢুকলে তো, বাবার টাকায় হৈ-চৈ করে, লোকে ভাবে বুদ্ধিমতী। ফলে মাথায় ঢোকানোর চেষ্টায় সেই অগুঢ় ইঙ্গিতের পুনরাবৃত্তি করতে হয়। শুনে যশোমতী লজ্জা পায় প্রথম, পরে চিন্তিত মুখে বলে, কিন্তু বাবার যে আবার অন্যরকম ইচ্ছে।
–দূর দূর দূর। বিতৃষ্ণায় নাক-মুখ দেখার মতোই কুঁচকে ওঠে দাদার।-কোথায় যোশী আর কোথায় বিশ্বনাথ। আত্মসম্মানবোধ থাকলে কেউ সেক্রেটারির কাজ করে। নিজেদের একটা কর্মচারীকে বিয়ে। বংশের কে কবে রাজা-উলীর ছিল বাবার কাছে সেটাই বড়। তুই জোর দিয়ে আপত্তি কর, লেখাপড়া শিখেছিস, অন্যের কথায় বিয়ে পর্যন্ত করতে হবে নাকি? আর বাবা তো তোকে একটু ভালোই বাসে, তোর আপত্তি শুনলে এগোবে না।
দাদার বরাবরই বিশ্বাস তার থেকেও বাবার চাপা স্নেহ এই বোকা বোনটার প্রতিই অনেক বেশি।
নিরীহ এবং চিন্তাচ্ছন্ন মুখে যশোমতী প্রস্তাব করে, আমার হয়ে বাবার কাছে আপত্তিটা তুমিই করে দাও না?
দাদা তিক্ত বিরক্ত, বিয়ে করবি তুই আর আমি যাব আপত্তি করতে। তাছাড়া বাবা অমনি ধরে নেবে আমার শালার টানেই ব্যাগড়া দিতে গেছি।
যশোমতী আরো কাতর মুখ করে জবাব দেয়, ধরলেই বা, সেটা তো আর সত্যি নয়, তুমি তো আমার মুখ চেয়েই বলতে যাচ্ছ। তা যদি না পারো তাহলে থাকগে, আমার কপালে যা আছে তাই হবে।
প্রায় হাল ছেড়েই দাদা আবার নতুন করে বোঝাতে বসে তাকে, সাহস দেয়, উদ্দীপনা সঞ্চার করে। যশোমতী শেষে তাকে ভরসা দিয়ে বলে, আচ্ছা, মনে মনে কিছুদিন আগে জোর গলায় আপত্তি করি, শেষে ঝপ করে বাবাকে একদিন বলে ফেলতে পারব।
সুযোগ পেলে মা-ও তার প্রস্তাব নিয়ে উপস্থিত হয়। তবে মা দাদার মতো অত বাঁকা রাস্তা ধরে এগোয় না। সোজা ব্যাপার ছাড়া মাথায় ঢোকে না, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতেও পারে না। মা সোজাসুজি বলে, মিসেস চতুর্বেদী তো মুখের কথা পেলেই কাজে নেমে পড়ে, আমাদের দিক থেকে আর দেরি করা উচিত নয়, রমেশের মতো ছেলের জন্য কত মেয়ের মা তো হাত বাড়িয়েই আছে।
আবার সেই নির্বুদ্ধিতার পুনরাভিনয়।–মেয়ের মা হাত বাড়িয়ে আছে কি না?
-আঃ! কমলা দেবী বিরক্ত, কিছু যদি বুঝিস–হাত বাড়িয়ে আছে মানে রমেশের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছে।
-ও…. তা দিচ্ছে না কেন?
কতবার বলব তোকে, তারা যে আমাদের সঙ্গেই কাজ করতে চায়!
যশোমতীর মুখখানা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হবেই এবার। মাকে তাতিয়ে তোলার মোক্ষম উপায়ই জানা আছে তার, অতএব হেসে ফেললে মুশকিল। তাই তার মতে সায় দেবার মতো করেই সমস্যাটা ব্যক্ত করবে। বলবে, দাদা যে আবার তার শালার কথা বলে?
-কি! মায়ের মেজাজ চড়বে তৎক্ষণাৎ।–এখনো বুঝি সে সেই মতলবে আছে? এক মেয়ে এনেই খুব আক্কেল হয়েছে, আবার ওই খানে। আস্পর্ধার কথা শুনলে গা জ্বলে যায়। সাফ না বলে দিবি। তাছাড়া বীরেন্দ্রও ছেলে আর রমেশও ছেলে….কার সঙ্গে কার তুলনা।
একজনের তুলনায় আর একজন ছেলে কিনা মায়ের প্রায় সেই সংশয়। মেয়েকে বোকার মতো চেয়ে থাকতে দেখে তার অস্বস্তি বাড়ে, আবার তোকে কি বলেছে শুনি?
করুণ অবস্থা যশোমতীর মুখের, বলছিল, যোণীর মতো এত গুণের ছেলে অর্ডার দিলেও আর মিলবে না, ভগবানের হাত ফস্কে ওই একজনই এসে গেছে।
রসিকতার ধার দিয়ে না গিয়ে মা রেগে লাল, ও বলল আর তুই অমনি ভুলে গেলি?
–ভুলব না বলছ?
দেখ, তোর বয়স হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছিস, একটু বুদ্ধি রেখে চলতে চেষ্টা কর। এই সব ওই বউয়ের কারসাজি, একজনকে তো কেড়েছে আবার তোর দিকে চোখ পড়েছে। রমেশের পাশে ওই যোশী একটা বাঁদর-যাকে বলে একটা কাক-বুঝলি?
মায়ের রাগের মুখে এই গোছেরই উপমা বেরোয়। যশোমতীরদু’চোখ কপালে, উচ্ছ্বসিত হাসির দমক আর ঠেকাতে পারেই না বুঝি।
এদিকে শিবজী আর ত্রিবিক্রম চুপ করে বসে নেই। তারা বিশ্বনাথ যাজ্ঞিককে চেনে রমেশ চতুর্বেদীকে চেনে। আর তাদের খুটির খবরও রাখে। ওরা নিজেরা দু’জনে আবার একাত্ম বন্ধু। ফলে রেষারেষিটা বাইরে থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। রমেশ বা বীরেন্দ্রর জন্য তাদের চিন্তা নেই। খোদ কর্তার ক্যাণ্ডিডেট বলে তাদের যা কিছু দুর্ভাবনা বিশ্বনাথকে নিয়ে আর পরস্পরকে নিয়ে। যখন আসে, প্রায়ই একসঙ্গে আসে দু’জনে। আর বৈচিত্র্যের আশায় দু-একটা প্রস্তাব তারাও করে, অনেকদিন একঘেয়ে কাটছে, একটু এক্সকারশনে বেরুলে হত….